জেন্ডার সমতায় বাংলাদেশ

যেতে হবে আরও বহুদূর

জেন্ডার সমতায় দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর মধ্যে সব সূচকে বাংলাদেশের এগিয়ে থাকা নিশ্চয়ই আনন্দের সংবাদ। যদিও সেই আনন্দ অনেকটাই ফিকে হয় আসে, যখন দেখি নারী-পুরুষের বৈষম্য এ অঞ্চলেই সবচেয়ে বেশি। সারা বিশ্বে পুরুষের পাশাপাশি নারীরা সমান সুযোগ পান কি না, সেটি পরিমাপ করতেই এই প্রতিবেদন।

দক্ষিণ এশিয়ায় জেন্ডার সমতায় বাংলাদেশের পরই ভুটানের অবস্থান, স্কোর ৬৮ দশমিক ২। শ্রীলঙ্কা, নেপাল, মালদ্বীপ ও ভারতের স্কোর যথাক্রমে ৬৬ দশমিক ৩, ৬৫ দশমিক ৯, ৬৪ দশমিক ৯ ও  ৬৪ দশমিক ৩। সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে পাকিস্তান, ৫৭ দশমিক ৫ ও আফগানিস্তান ৪০ দশমিক ৫ স্কোর নিয়ে।

বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) সর্বশেষ বৈশ্বিক জেন্ডার সমতা প্রতিবেদন ২০২৩-এ বাংলাদেশের অর্জন ৭২ দশমিক ২। বৈশ্বিক মানচিত্রে অবস্থান হলো ৫৯তম। ২০১৪ সাল থেকে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় এক নম্বরে আছে শ্রীলঙ্কাকে টপকে। 

রাষ্ট্র ও সমাজজীবনের অন্যান্য সূচকে যখন আমরা পিছিয়ে, তখন জেন্ডার সমতার এই অর্জনটুকুও কম নয়। ২০২২ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৭১ ও নম্বর ছিল ৭১ দশমিক ৪ শতাংশ। জেন্ডার সমতার প্রশ্নে যেসব বিষয় বিবেচনায় আনা হয়, তা হলো—অর্থনীতিতে অংশগ্রহণ ও সুযোগ, শিক্ষায় অভিগম্যতা, স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন।

স্বীকার করতে হবে, বাংলাদেশে শিক্ষায় নারীর সুযোগ অনেক বেড়েছে। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছেলেশিশুর চেয়ে মেয়েশিশু বেশি। পাবলিক পরীক্ষা ও উচ্চশিক্ষায়ও অনেক সময় ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা ভালো ফলাফল করে কিন্তু কর্মক্ষেত্রে পিছিয়ে।

কর্মক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ এখনো শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবাতেই বেশি পরিলক্ষিত হয়।

অন্যান্য আরও ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে, তবে তা আরও বেশি হওয়া উচিত।

গড় আয়ুতে মেয়েরা একসময় পুরুষের চেয়ে বেশ এগিয়ে থাকলেও করোনার কারণে সেটি কিছুটা কমেছে। 

তিন দশক ধরে নারী রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন, যার দৃষ্টান্ত অন্য কোথাও নেই। সেই সঙ্গে সংসদে বিরোধী দলের নেতা ও স্পিকারের আসনেও আছেন নারী। তবে সেই তুলনায় মন্ত্রিসভা ও জাতীয় সংসদে নারীর প্রতিনিধিত্ব কম—এক–দশমাংশ। ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে প্রায় সব দলেরই অঙ্গীকার ছিল, ২০২১ সালের মধ্যে দলের সব স্তরে এক-তৃতীয়াংশ নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা হবে। কোনো দলই সেই শর্ত পূরণ করতে পারেনি। স্থানীয় সরকার সংস্থায় এক-তৃতীয়াংশ নারী সদস্য থাকলেও তাঁদের কাজের সুযোগ সীমিত। কেবল সংখ্যা দিয়ে যে নারীর ক্ষমতায়ন বিচার করা যায় না, তার প্রমাণ আমরা সংসদের ভেতরে ও বাইরে দেখতে পাচ্ছি। রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী ইশতেহারে সংসদে সরাসরি ভোটে এক-তৃতীয়াংশ নারী প্রতিনিধিত্বের অঙ্গীকার ছিল, যা এখনো অবাস্তবায়িত রয়ে গেছে।

নারী-পুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে হলে আমাদের পিছিয়ে পড়াদের মধ্যে এক নম্বর হলে চলবে না। সামনে এগিয়ে থাকা আইসল্যান্ড, ফিনল্যান্ড, নরওয়ে, সুইডেন প্রভৃতি দেশের সঙ্গে পাল্লা দিতে হবে। আইসল্যান্ড ৯০ স্কোর পেয়ে এক নম্বরে আছে। আমাদের স্কোর ৭২ দশমিক ২। সে ক্ষেত্রে খুব বেশি পিছিয়েও নেই। 

শিক্ষাঙ্গনে নারী-পুরুষের সমতার মতো অন্যান্য সব ক্ষেত্রেও সেটি নিয়ে আসতে হবে। এখনো নানা অজুহাতে বহু শিক্ষিত নারীকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে দূরে রাখা হয়।

তিন দশক ধরে রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী পদে নারী থাকলেও রাষ্ট্র ও সমাজের চরিত্রটি এখনো পুরুষতান্ত্রিক। 

কেবল পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনের সব ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সম-অংশীদারত্বের মাধ্যমেই জেন্ডার সমতা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। বাংলাদেশও আইসল্যান্ড হওয়ার স্বপ্ন দেখতে পারে।