সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়

জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ

পদাধিকারীদের জবাবদিহি থাকবে না কেন

যখন অন্যান্য রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা খারাপ ছিল, জনতা ব্যাংক ভালো অবস্থায় ছিল। তাদের মূলধন ও ঋণের মধ্যে ভারসাম্য ছিল। ব্যাংকটিও মোটামুটি ভালো ব্যবসা করেছে।

কিন্তু ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর অন্যান্য রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের মতো এই ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদেও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়ার কারণে খেলাপি ঋণের মাত্রা বেড়ে যেতে থাকে। অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক পরিচালনার জন্য একসময় বাজেটে বিশেষ বরাদ্দ রাখতে হয়েছিল।

সেই অবস্থা থেকে কিছুটা উত্তরণ সম্ভব হলেও যথেচ্ছভাবে ঋণ দেওয়ার কারণে জনতা ব্যাংকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ক্রমেই বেড়ে যেতে থাকে। কখনো চেয়ারম্যানের স্বেচ্ছাচারিতা, কখনো ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) স্বজনপ্রীতির কারণে ব্যাংকটি আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। আব্দুছ ছালাম আজাদ ২০১৭ সালে যখন জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছিলেন, ব্যাংকটির বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল ৪৫ হাজার ৯৫৮ কোটি টাকা।

এর মধ্যে খেলাপি ছিল ৭ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। এখন ব্যাংকটির ঋণ বেড়ে হয়েছে ৮৫ হাজার ২০৬ কোটি টাকা, আর খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ১৪ হাজার ৩৮৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ, গত সাড়ে পাঁচ বছরে ঋণ বিতরণ ও খেলাপি ঋণ বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। আইনে আছে, মূলধনের ২৫ শতাংশের বেশি এক গ্রুপকে দেওয়া যাবে না। এর বেশি ঋণ গেলে ব্যাংকের জন্য বড় ঝুঁকি হয়ে যায়। আবদুছ ছালাম আজাদের মেয়াদ শেষ হচ্ছে ২৯ এপ্রিল।

বর্তমান এমডি ব্যাংকের দুরবস্থার দায় না নিয়ে তিনি সাবেক চেয়ারম্যান ও এমডিদের ওপর চাপাতে চান। আবার সাবেকেরা বলেন, তাঁরা সবকিছু নিয়মমাফিক করেছেন। তাহলে এ অবস্থা তৈরি হওয়ার জন্য কে দায়ী? প্রথম আলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, জনতা ব্যাংকের শীর্ষ ঋণখেলাপি অ্যাননটেক্স ও ক্রিসেন্ট গ্রুপ এবং প্রভাবশালী বেশ কিছু ব্যবসায়ী। আবার এসব ঋণখেলাপির মধ্যে এমন ব্যবসায়ীও আছেন, যাঁরা ব্যাংকসুদ মাফ করিয়ে শীর্ষতম ঋণখেলাপির প্রতিষ্ঠান কিনে নেওয়ার চেষ্টা করছেন।

বর্তমান সরকারের আমলে কেবল জনতা ব্যাংকেই যে ঋণ কেলেঙ্কারি হয়েছে, তা নয়। ঋণ কেলেঙ্কারি হয়েছে সোনালী ও বেসিক ব্যাংকেও। কথিত উদ্যোক্তা ও রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা কোটি কোটি টাকা ঋণ নিয়ে বিদেশে পাচার করে দিয়েছেন বলেও অভিযোগ আছে।

ব্যাংক একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান। এটি পরিচালিত হয় কতগুলো নিয়মকানুনের ওপর। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তাঁদেরই ঋণ দেবে, যঁাদের কাছ থেকে সেই ঋণ তুলে নিতে পারবে। অন্য বিবেচনা বা রাজনৈতিক প্রভাবে ঋণ দিলে ব্যাংক দেউলিয়া হতে বাধ্য।

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোয় খেলাপি ঋণের পরিমাণ মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে যাচ্ছে, তার জন্য কি কোনো চেয়ারম্যান, পর্ষদ সদস্য কিংবা এমডিকে জবাবদিহি করতে হয়েছে? হলে সোনালী ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক ও জনতা ব্যাংকের পদাধিকারীরা এভাবে দায়মুক্তি পেতেন না। ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারির বিষয়টি কখনো মামলা পর্যন্ত গড়ালেও পরে অদৃশ্য অঙ্গুলি হেলনে থেমে যায়। জনতা ব্যাংকের ক্ষেত্রে তেমন কিছু হচ্ছে কি না, সেটা তদন্ত করে দেখা দরকার।

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক পরিচালনার ক্ষেত্রে আরেকটি বড় সমস্যা হলো দ্বৈত শাসন। অভিভাবক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকই এসব ব্যাংকের আয়-ব্যয়ের বিষয়টি তদারক করে থাকে। কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অযাচিত হস্তক্ষেপের কারণে তার পক্ষেও আইনি ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয় না। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে ঠিকমতো পরিচালিত করতে হলে দ্বৈত শাসনেরও অবসান দরকার।