সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়

ত্রাণ বরাদ্দ বাড়ান ও পুনর্বাসনে নজর দিন

আগস্ট থেকে অক্টোবরের প্রথম ভাগ পর্যন্ত দেশজুড়ে থেমে থেমে ভারী বৃষ্টি এবং দেশের উত্তর–পূর্বাঞ্চলসহ শেরপুর, ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনার বন্যা-ভাটির দেশ বাংলাদেশের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতের বিষয়টিকে সুস্পষ্টভাবে সামনে নিয়ে এল। এ রকম বন্যা, খরা ও ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে আগামী দিনে এ ভূমির মানুষেরা কীভাবে নিজেদের আত্মস্থ করে নিতে পারবে, সেই চিন্তাকে কেন্দ্রে রেখে যৌথ নদীর পানি ব্যবস্থাপনা ও দুর্যোগ মোকাবিলার নীতি ও কৌশল ঢেলে সাজানোর সময় এসেছে।

এর জন্য মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি নীতি ও পরিকল্পনা দরকার। কিন্তু এ মুহূর্তে বন্যাদুর্গত এলাকায় ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রমে সর্বোচ্চ মনোযোগ দেওয়ার বিকল্প নেই। কেননা, আকস্মিক বন্যায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ যেমন ব্যাপক, তার প্রভাবও বহুমাত্রিক। সরকারি খাতে যোগাযোগ অবকাঠামো থেকে শুরু করে ব্যক্তি খাতে কৃষি, মৎস্য থেকে শুরু করে হাজারো মানুষের ঘরবাড়ি যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাতে বন্যা উপদ্রুত অঞ্চলে অর্থনীতি ও জীবনযাত্রার ওপর সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়বে।

উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, এত বড় দুর্যোগে যেভাবে লাখ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেই তুলনায় সাড়া দেওয়ার ব্যাপারে অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগ, ব্যবস্থাপনা ও সমন্বয়ে ঘাটতি লক্ষ করা যাচ্ছে। এটা মোটেই কাম্য নয়। একটা বিষয় সবাইকে স্বীকার করে নিতে হবে, ভেঙে পড়া রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও আর্থিক খাতের সংস্কার ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে তাদের প্রচেষ্টার অনেকটা ব্যয় করতে হচ্ছে। কিন্তু তাই বলে বন্যার ত্রাণ কার্যক্রম ও পুনর্বাসন নিয়ে শৈথিল্যের কোনো সুযোগ নেই।

প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের কারণে শেরপুর, ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনায় বর্তমানে যে বন্যা চলছে, তাতে এ পর্যন্ত আটজন মারা গেছেন। এ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২ লাখ ৩২ হাজারের বেশি মানুষ। বুধবার পর্যন্ত কোথাও কোথাও বন্যার উন্নতি হলেও বেশির ভাগ জায়গায় অবনতি হয়েছে। জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে শুকনা ও রান্না করা খাবার বিতরণ করা হলেও চাহিদার তুলনায় সেটা অপ্রতুল। অনেক এলাকায় চার দিন পরও ত্রাণ পৌঁছায়নি। ফলে খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, এ তিন জেলায় আমনের আবাদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

এর আগে উত্তর ও পূর্বাঞ্চলের বন্যার সময়ও ত্রাণ বরাদ্দে অপ্রতুলতা ও বিতরণ নিয়ে সমন্বয়হীনতা দেখা গেছে। পূর্বাঞ্চলে বন্যার সময় ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের উদ্যাগে দুর্গতদের পাশে দাঁড়ালেও পরের দুই বন্যার ক্ষেত্রে নাগরিকদের উদ্যোগ সীমিত হয়ে গেছে। আগস্ট মাসে পূর্বাঞ্চলের ১১টি জেলায় বন্যার ক্ষয়ক্ষতি ও পুনর্বাসন নিয়ে তাৎক্ষণিক একটা গবেষণা করেছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। সংস্থাটির গবেষণায় উঠে এসেছে ত্রাণসহায়তার ক্ষেত্রে সমন্বয়হীনতার চিত্র। বন্যায় মোট ক্ষতির পরিমাণ প্রায় সাড়ে ১৪ হাজার কোটি টাকা। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে নোয়াখালী জেলায়, অথচ বেশি ত্রাণসহায়তা গেছে সিলেট জেলায়।

বন্যাদুর্গত এলাকায় ত্রাণের বরাদ্দ বাড়ানোর বিকল্প নেই। এ ক্ষেত্রে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয় সাধন জরুরি। এসব অঞ্চলে ঘরবাড়ির যে ক্ষতি হয়েছে, তা মেরামতে ক্ষতিগ্রস্তদের দীর্ঘ মেয়াদে আর্থিক সহায়তা দেওয়া প্রয়োজন। আমন ধান ও অন্যান্য কৃষি এবং মৎস্য ও পোলট্রি খাতে যে ক্ষতি হয়েছে, পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কৃষক ও খামারিরা যাতে পুরোদমে উৎপাদন শুরু করতে পারেন, সে জন্য সহায়তা দিতে হবে। হিন্দুধর্মাবলম্বীদের দুর্গাপূজা শুরু হয়েছে। বন্যাদুর্গত এলাকায় হিন্দুধর্মাবলম্বীরা যাতে নির্বিঘ্নে পূজা-অর্চনা করতে পারেন, সেদিকেও নজর দেওয়া প্রয়োজন।

বন্যা প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলেও শক্তিশালী ব্যবস্থাপনা ও সমন্বয়ের মাধ্যমে জনদুর্ভোগ লাঘব ও ক্ষয়ক্ষতি কমানো অসম্ভব নয়।