বাসযোগ্যতার সব সূচকে রাজধানী ঢাকা যখন তলানির দিকে অবস্থান করছে, সে সময়ে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) সক্রিয় ও জোরালো ভূমিকা যেখানে বাঞ্ছনীয়, সেখানে স্রেফ উল্টো পথেই হাঁটছে সংস্থাটি। সরকারি উদ্যোগে গড়ে ওঠা রাজধানীর চারটি পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা রাজউকের চোখের সামনেই ধীরে ধীরে বাণিজ্যিক এলাকায় রূপ নিচ্ছে।
বাধা তো দেওয়া হয়ইনি, এখন বরং তোড়জোড় করে এলাকাগুলোর ভূমিসংক্রান্ত নকশা সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। নির্দিষ্ট ফির বিনিময়ে অনিয়মকে বৈধতা দেওয়ার আয়োজন চলছে।
প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, ঢাকার পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা হিসেবে গড়ে ওঠা গুলশান, বনানী, বারিধারা ও উত্তরায় ১৬ হাজার ১৩টি প্লটের মধ্যে অন্তত ১ হাজার ২৮১টি প্লট অবৈধভাবে বাণিজ্যিক বা অনাবাসিক কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। এসব প্লটের মালিকেরা আবাসিক ভবনের অনুমোদন নিলেও সেখানে বিপণিবিতান, হোটেল, রেস্তোরাঁসহ অন্যান্য বাণিজ্যিক কাজ চলছে।
পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ যে বনানীর প্রায় অর্ধেক প্লট এখন বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। গুলশানের এক-তৃতীয়াংশ আর বারিধারার এক-পঞ্চমাংশ প্লট বাণিজ্যিক হয়ে গেছে। উত্তরাতেও জোরেশোরে বাণিজ্যিকীকরণ চলছে। ফলে যানজট, শব্দদূষণসহ নানা নাগরিক সমস্যা বাড়ছেই।
খোদ রাজউকের নিয়ম অনুযায়ী আবাসিক প্লটে বাণিজ্যিক কার্যক্রম যেখানে নিষিদ্ধ, সেখানে কীভাবে এই অনিয়ম চলতে পেরেছে? এ ধরনের কার্যক্রম ঠেকানোর দায়িত্ব রাজউকের উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ শাখার। অথচ সেখানকার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাই বলছেন, অবৈধভাবে প্লটের বাণিজ্যিক ব্যবহারের তথ্য তাঁর কাছে নেই। তদারকি কর্তৃপক্ষই যখন এমন অকার্যকর ও নিষ্ক্রিয়, সেখানে বাস্তব পরিস্থিতি কী হতে পারে, সেটা সহজেই অনুমেয়।
একটা নগরের বাসযোগ্যতার পূর্বশর্ত হলো পরিকল্পিত নগরায়ণ। বিশ্বে ঢাকা একমাত্র নগর নয় যে রাজউকের সামনে আর কোনো অভিজ্ঞতা কিংবা দৃষ্টান্ত নেই। বিশ্বের বাসযোগ্য কোনো নগরেই আবাসিক এলাকার মধ্যে এভাবে বাণিজ্যিক এলাকা গড়ে তোলা হয় না।
কর্মদিবসগুলোতে পুরো ঢাকা যে যানজটে স্থবির হয়ে পড়ে, তার বড় কারণ আবাসিক এলাকা ও বাণিজ্যিক এলাকার কোনো সীমারেখা এখানে নেই। অপরিকল্পিত নগরায়ণ, তদারকি কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা ও খামখেয়ালি কতটা ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে, সাম্প্রতিক কালে তার বড় দৃষ্টান্ত তুরস্ক।
নগর-পরিকল্পনাবিদেরা বলছেন, কোনো আবাসিক এলাকায় বাণিজ্যিক ব্যবহার রাতারাতি হয় না। রাজউকের চোখের সামনেই এগুলো হয়েছে। অথচ এই অনিয়মকে বৈধতা দিতে নীতিমালা করেছে রাজউক। খসড়া নীতিমালা অনুযায়ী অবৈধভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে, এমন আবাসিক প্লটগুলোর নকশা সংশোধনের মাধ্যমে বাণিজ্যিক প্লটে রূপান্তর করা হবে। কাঠাপ্রতি ৫০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকা ফির বিনিময়ে সেটা বৈধতা পাবে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি মোহাম্মদ ফজলে রেজা মনে করেন, রাজউকের এ ধরনের উদ্যোগ শুধু বেআইনি হবে না, অনৈতিকও হবে। প্রশ্ন হলো, কতিপয় সুবিধাভোগীর স্বার্থে এভাবে আবাসিক এলাকাগুলোর বাসযোগ্যতা বিনষ্ট করার এখতিয়ার রাজউক কোথা থেকে পেল?
নীতিমালা সংশোধন ও ফির বিনিময়ে অনিয়মকে যেভাবে বৈধতা দেওয়ার আয়োজন করছে রাজউক, সেটা রাজধানীর অন্যান্য আবাসিক এলাকার ক্ষেত্রেও বাজে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। ভবিষ্যতে এ ধরনের কোনো অনিয়ম হলে তার বিরুদ্ধ ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে নৈতিক শক্তি কোথায় পাবে রাজউক।
আবাসিক প্লটকে বাণিজ্যিক প্লটে রূপান্তর করার মতো আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত থেকে রাজউক সরে আসবে বলেই আমরা মনে করি। যাঁরা আবাসিক প্লটগুলোকে অবৈধভাবে বাণিজ্যিক প্লটে পরিণত করেছেন, তাঁদের অনিয়মের বৈধতা দেওয়ার দায়িত্ব রাজউকের নয়।