সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়

কেবল বক্তৃতায় কাজ হবে না

স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে কিছু কথা বলেছেন, যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একই সঙ্গে উদ্বেগজনকও। সম্প্রতি ‘এসডিজি লোকালাইজেশন: ফাইন্ডিংস অ্যান্ড ওয়ে ফরওয়ার্ড’ শীর্ষক কর্মশালায় তিনি খেদের সঙ্গে বলেছেন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের অনেকেই নিজেদের দায়িত্ব সম্পর্কে জানেন না।

তাঁদের অনেকের শিক্ষার যোগ্যতার ঘাটতি আছে। তাঁদের জন্য পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যায়নি। জাতীয় স্থানীয় সরকার ইনস্টিটিউটের (এনআইএলজি) সক্ষমতার ঘাটতি রয়েছে। এনআইএলজির আর্থিক ও লজিস্টিক ঘাটতি রয়েছে।’

স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন আসবে, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের যোগ্য করে তোলার ক্ষেত্রে সরকার কী পদক্ষেপ নিয়েছে? পূর্বসূরিদের কথা যদি বাদও দিই, বর্তমান স্থানীয় সরকারমন্ত্রীর দায়িত্বও চার বছর পূর্ণ হতে চলেছে। এই সময়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্বজ্ঞানশীল করতে তাঁরা কী পদক্ষেপ নিয়েছেন? সংবিধানে স্থানীয় শাসনের তিনটি দায়িত্বের কথা বলা আছে, যার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো জনসাধারণের কার্য ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্পর্কিত পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন।

দেখার বিষয় সেই পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের সুযোগ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের হাতে কতটা আছে? সংবিধানে স্থানীয় শাসনের কথা বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে সেটা পুরোপুরি সরকারের কর্তৃত্বাধীন। উন্নয়ন প্রকল্পের বেশির ভাগ অর্থও আসে কেন্দ্র থেকে। এ অবস্থায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের যথাযথ ভূমিকা রাখা যে প্রায় অসম্ভব, সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।

স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচনগুলো আগে নির্দলীয় ভিত্তিতে হতো। জাতীয় রাজনীতিতে যতই টানাপোড়েন থাকুক না কেন, স্থানীয় নির্বাচনগুলো সব সময় প্রতিযোগিতামূলক হতো। অত্যন্ত বেদনার বিষয় হলো দলীয় ভিত্তিতে নির্বাচন শুরু হওয়ার পর সেই প্রতিযোগিতা অনেকটাই অনুপস্থিত। কয়েক বছর ধরেই প্রধান বিরোধী দল নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না। মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় আওয়ামী লীগ মনোনীত ও ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থীর মধ্যে। সাম্প্রতিক কালে প্রায় সব নির্বাচনে সেটা হয়ে আসছে। বিনা নির্বাচনে জয়ী হওয়ার ঘটনাও কম নয়।

মন্ত্রী স্থানীয় সরকার জনপ্রতিনিধিদের যোগ্যতা, দক্ষতা ও প্রশিক্ষণ নিয়ে যে প্রশ্ন তুলেছেন সেটা কেবল তাঁদের ক্ষেত্রে নয়, জাতীয় সংসদের অনেক সদস্যের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। দেশের সর্বোচ্চ প্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠান জাতীয় সংসদের অধিবেশনের কার্যবিবরণী পড়লে বা সংসদ সদস্যদের বিতর্ক শুনলে অনেক সময় মনে হয়, তঁাদের অনেকেরই সংসদীয় ব্যবস্থা ও রীতি সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। অনেক সংসদ সদস্য প্রশ্ন কীভাবে করতে হয়, সেটাও জানেন না। সংসদ সদস্যদের মূল দায়িত্ব যে আইন প্রণয়ন, সে বিষয়েও তাঁরা আদৌ ওয়াকিবহাল বলে মনে হয় না।

এমনকি সংসদের বাজেট অধিবেশনে বেশির ভাগ সংসদ সদস্য বাজেট নিয়ে একটি কথাও বলেন না। প্রতিপক্ষকে কথার বাণে বিদ্ধ করতেই তাঁরা বেশি সময় ব্যয় করেন। বাকি সময়টা এলাকার সমস্যা নিয়ে কথা বলেন। এলাকার সমস্যার কথা সংসদ সদস্যরা বলবেন। কিন্তু জাতীয় বাজেটের ভালো-মন্দ নিয়েও আলোচনা করা খুবই জরুরি কাজ।

স্থানীয় সরকার জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্ববান করতে হলে, তাঁদের স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাও দিতে হবে। একই সঙ্গে স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলোর ওপর কেন্দ্রীয়ভাবে সরকারের খবরদারি ও কর্তৃত্বও কমাতে হবে। উন্নত দেশের কথা যদি বাদও দিই, আমাদের নীতিনির্ধারকেরা অন্তত ভারতে কীভাবে স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলো পরিচালিত হয়, দেখে নিতে পারেন। কেবল বক্তৃতা বা উপদেশ দিয়ে স্থানীয় সরকার জনপ্রতিনিধিদের যোগ্যতা বাড়বে না; তঁাদের কাজেরও সুযোগ দিতে হবে।