করোনা মহামারিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা। টানা ১৮ মাস শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থাকা শিক্ষা থেকে নানাভাবে পিছিয়ে পড়ে শিক্ষার্থীরা। অনেকে শিশুশ্রমে যুক্ত হয়ে পড়ে, অনেকের বাল্যবিবাহ হয়ে যায়। শ্রেণিকক্ষে ফিরলেও অনেক শিক্ষার্থী এখনো পাঠ্যপুস্তক ও পাঠদানের সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না।
এ সংকট মেটাতে সরকারিভাবে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়, তা কতটা কার্যকর হয়েছে বা হচ্ছে, সেসব নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। এরপরও কিছু উদ্যোগ আমরা দেখতে পাচ্ছি, যা বেশ প্রশংসাজনক।
শ্রীমঙ্গল উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আলী রাজীব মাহমুদ উপজেলার স্কুলগুলোয় ‘রিডিং অ্যান্ড রাইটিং হসপিটাল’ নামে দারুণ একটি উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। এ ‘হাসপাতালে’ মূলত পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের শিক্ষাঘাটতি পূরণের ‘চিকিৎসা’ দেওয়া হয়। প্রতিটি দলে ছয়জন শিক্ষার্থী থাকে, সেখান থেকেই অপেক্ষাকৃত এগিয়ে থাকা একজনকে বেছে নেওয়া হয় প্রতীকী চিকিৎসক হিসেবে। সেই চিকিৎসকই প্রতিদিন এক ঘণ্টা করে দলের বাকি শিক্ষার্থীদের পড়ালেখায় সহযোগিতা করে।
রাজীব মাহমুদ গত বছর ইউএনওর দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই বিভিন্ন স্কুল পরিদর্শনে যান। তখন তিনি দেখতে পান, শহরের বাইরের প্রাথমিক স্কুলগুলোর অধিকাংশ শিক্ষার্থী ভালোভাবে বাংলা পড়তে পারছে না, ইংরেজি ও অঙ্কে তারা আরও দুর্বল। করোনাকালে স্কুল বন্ধ ও পরীক্ষা না থাকায় এ সমস্যা তৈরি হয়েছে।
তখন তিনি নিজ আগ্রহে এ হাসপাতাল চালুর উদ্যোগ নেন। উপজেলার ৮৬টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এ ‘হাসপাতাল পরিচালনার’ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এখন ৩৯টি স্কুলে পুরোদমে ‘হাসপাতাল’ চালু আছে।
এ ‘হাসপাতালে’ খেলার ছলে অক্ষর, যুক্তাক্ষর, ইংরেজি ওয়ার্ড ও অঙ্ক শেখান একজন চিকিৎসক, যিনি মূলত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক। পাশাপাশি প্রতীকী চিকিৎসকেরা নিজ নিজ দলকে বুদ্ধি-পরামর্শ দেয়। শিখে আসা বিষয়গুলো ভালোভাবে আয়ত্ত করেছে কি না, সেটিও যাচাই করে দেখেন চিকিৎসক। হাসপাতালে দেয়ালে টাঙানো অক্ষর, শব্দ, বাক্য ও পত্রিকা স্ট্যান্ডে রাখা বাংলা পত্রিকা, গল্পের বই পড়ার ব্যবস্থা আছে শিক্ষার্থীদের। শিক্ষার্থীদের যারা পড়তে পারছে, তাদের ‘ছাড়পত্র’ দেওয়া হচ্ছে। আবার তাদের জায়গায় নতুন শিক্ষার্থী আসছে।
এখন শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় আগ্রহ বাড়ছে। তারা ভালোভাবে পড়তে ও লিখতে পারছে। স্কুলে এমন ‘হাসপাতাল’ খুলতে তেমন কোনো খরচ নেই। মূলত, দরকার শিক্ষক-শিক্ষার্থী, শিক্ষা কর্মকর্তা, সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা ও বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের আন্তরিক প্রচেষ্টা।
জেলা প্রশাসকের তত্ত্বাবধান ও নির্দেশনা এবং নিজের নেতৃত্বগুণে এ কাজে সফলতা অর্জন করেছেন রাজীব মাহমুদ। একজন সরকারি কর্মকর্তা চাইলেই একটি উপজেলায় কতভাবে অবদান রাখা যায়, সেটিই মূলত প্রমাণ করলেন তিনি। এমন উদ্যোগ গোটা দেশে অনুসরণীয় হয়ে উঠবে, সেটিই আমাদের কামনা।