সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়

স্বেচ্ছাতন্ত্রের ছায়ায় আর কত দিন

বৈশ্বিক শাসনব্যবস্থা নিয়ে সুইডেনের গোথেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ভি-ডেম’ (ভ্যারাইটিজ অব ডেমোক্রেসি) ইনস্টিটিউট যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তা বাংলাদেশের জন্য মোটেই সুখকর নয়। ২ মার্চ প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী ১৭৯টি দেশের মধ্যে উদার গণতান্ত্রিক সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৭তম।

এ ছাড়া নির্বাচনভিত্তিক গণতন্ত্রের সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩১তম, লিবারেল কম্পোনেন্ট (উদারনৈতিক উপাদান) সূচকে ১৫৫তম, সমতার উপাদান সূচকে ১৬৫তম এবং অংশগ্রহণমূলক উপাদানে ১৪২তম। নির্বাচনভিত্তিক গণতন্ত্রের সূচকে (ইলেকটোরাল ডেমোক্রেসি ইনডেক্স) বাংলাদেশের অবনমন হয়েছে।

সূচকে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থান শূন্য দশমিক ২৮ স্কোর নিয়ে ১৩১তম। স্কোর কমেছে প্রায় শূন্য দশমিক শূন্য ৩। শাসনতান্ত্রিক দিক থেকে বাংলাদেশকে ‘নির্বাচনভিত্তিক স্বেচ্ছাতন্ত্র’ (ইলেকটোরাল অটোক্রেসি) বিভাগে রেখেছে ভি-ডেম ইনস্টিটিউট। গতবারের প্রতিবেদনেও বাংলাদেশের অবস্থান একই ছিল।

বিশ্বব্যাপী কর্তৃত্ববাদী শাসনের জোয়ার চলছে। বর্তমানে বিশ্বের ৭২ শতাংশ মানুষই এখন স্বেচ্ছাতন্ত্রের অধীনে আছে। ১০ বছর আগেও যা ছিল ৪৮ শতাংশ। কেন গণতন্ত্রের সব সূচকে বাংলাদেশের ধারাবাহিক অবনতি ঘটছে, তা আমাদের কারোরই অজানা নয়। স্বাধীনতার ৫১ বছরে আমরা অর্থনৈতিকভাবে অনেক উন্নতি করেছি। করোনা মহামারির আগপর্যন্ত প্রায় সব অর্থনৈতিক সূচকে আমরা এগিয়ে ছিলাম। কিন্তু রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তার বিপরীতটাই ঘটছে।

আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে ভুলে গেলে চলবে না যে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ১৯৭০ সালের নির্বাচনের রায় বানচাল করে দেওয়ার প্রতিবাদেই এ দেশের মানুষ অস্ত্র হাতে নিয়েছিলেন এবং মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন করেছেন। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের চার মূলনীতিরও অন্যতম গণতন্ত্র। গণতন্ত্রের প্রত্যয় নিয়ে যে রাষ্ট্রের জন্ম, সেই রাষ্ট্রে গণতন্ত্রের এই বেহাল দশা মেনে নেওয়া যায় না।

পূর্বাপর সব দলীয় সরকারই নির্বাচনকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছে। আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব বিরোধী দলে থাকতে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করলেও ক্ষমতায় গিয়ে সেটি বেমালুম ভুলে যায়। এটি যে কেবল জাতীয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে হয়েছে, তা নয়। ব্যতিক্রম বাদে স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচনগুলোও হয়ে পড়েছে একতরফা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন। যত দিন এসব নির্বাচন নির্দলীয়ভাবে হতো, তত দিন ক্ষমতার ভারসাম্য ছিল। কিন্তু স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলো দলীয় বৃত্তে নেওয়ার পর এটি অনেকটা প্রহসনে রূপ নিয়েছে।

এ কথা সত্য যে বাংলাদেশের নির্বাচনী গণতন্ত্রের অবস্থা কতটা শোচনীয় হয়েছে, তা বোঝার জন্য আন্তর্জাতিক কোনো গবেষণা সংস্থার প্রতিবেদনের প্রয়োজন পড়ে না। এই দেশের ভোটাধিকার হারানো মানুষ তিক্ত অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। নির্বাচনী ব্যবস্থা ও প্রতিষ্ঠান কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়েছে। নির্বাচন কমিশন কাগজপত্রে স্বাধীন হলেও বাস্তবে তারা ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছা পূরণ করে চলেছে। অন্তত গত দুটি নির্বাচন কমিশনের ক্ষেত্রে এ কথা শতভাগ সত্য।

গণতন্ত্রের মূল কথাই হলো জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন এবং তাঁদের ভোটে নির্বাচিত সরকার কর্তৃক দেশ পরিচালনা। সুষ্ঠু নির্বাচন ছাড়া তা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। দুর্ভাগ্যজনক বাস্তবতা হচ্ছে, বাংলাদেশে দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনই সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হয়নি। যে কটি নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য হিসেবে বিবেচিত, সেগুলো হয়েছে নির্দলীয় বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে।

এক বছরের কম সময়ের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন হতে যাচ্ছে। আমরা যদি সত্যিকার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চাই, গণতন্ত্রের সূচকের লজ্জাজনক অবনতি ঠেকাতে চাই, তাহলে নিয়ম রক্ষার নির্বাচন না করে প্রকৃত অর্থে একটি অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন করার বিকল্প নেই।