গাজীপুর সিটি নির্বাচন

সুষ্ঠু ভোটের ধারাবাহিকতা যেন বজায় থাকে 

গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে। স্থানীয় সরকার পর্যায়ের নির্বাচন হলেও জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কয়েক মাস আগে অনুষ্ঠিত এই নির্বাচন নানা কারণেই তাৎপর্যপূর্ণ। এই সিটি নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নিলেও ভোটের লড়াইয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে হারিয়ে মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী।

প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, বৃহস্পতিবার সকাল আটটা থেকে শুরু হয়ে বিকেল চারটা পর্যন্ত সব কটি কেন্দ্রে ইভিএমে ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। বেসরকারি ফলাফলে সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের মা জায়েদা খাতুন সরকারদলীয় প্রার্থী আজমত উল্লাকে ১৬ হাজারের বেশি ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করেছেন। সাম্প্রতিক কালে অনুষ্ঠিত স্থানীয় সরকার ও জাতীয় সংসদের উপনির্বাচনগুলোর তুলনায় গাজীপুর সিটি নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। সকাল থেকেই দীর্ঘ লাইনে নারী, পুরুষ, বয়স্ক, তরুণ—সব শ্রেণির ভোটারদের ভোট দিতে দেখা যায়। 

নির্বাচন ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে গাজীপুরে কিছু দিক লক্ষ করা গেছে। এবারের নির্বাচনে প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছিল। তবে এই নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার পেছনে যা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, তা হচ্ছে ভোটের দিন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কারও পক্ষ না নেওয়া, ভোটকেন্দ্রের গোপন কক্ষে (বুথ) অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিদের উপস্থিতি না থাকা এবং সরকারদলীয় প্রার্থীদের জবরদস্তির যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, তা না থাকা। এসব কারণে ভোটের সামগ্রিক পরিবেশ ছিল শান্তিপূর্ণ। তবে ইভিএমে আঙুলের ছাপ না মেলায় ভোট দিতে দেরি হওয়ায় ভোগান্তির অভিযোগ করেছেন অনেকে। অনেকগুলো কেন্দ্রেই সরকারদলীয় প্রার্থীর এজেন্টের বাইরে অন্য কোনো প্রার্থীর এজেন্ট না থাকলেও সিসি ক্যামেরা থাকায় অনিয়মের ঘটনা দেখা যায়নি।

গাজীপুরে নৌকার প্রার্থী অপরিচিত ও অনভিজ্ঞ প্রার্থীর কাছে হেরেছেন। এর আগে ২০১৩ সালে গাজীপুর সিটির প্রথম নির্বাচনে বিএনপির নেতা এম এ মান্নানের কাছেও তিনি হেরে গিয়েছিলেন।

অবস্থাদৃষ্টে এটা স্পষ্ট যে গাজীপুর আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা আজমত উল্লাকে হারিয়ে জায়েদা খাতুনের নির্বাচিত হওয়ার পেছনে সরকারদলীয় প্রার্থীর প্রতি ভোটারদের অনাস্থাই মূল ভূমিকা পালন করেছে। মেয়রের দায়িত্ব পালনকালে জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে অনিয়মের নানা অভিযোগ ছিল। কিন্তু নির্বাচনের ফলাফল দেখে মনে হচ্ছে, যে প্রক্রিয়ায় তাঁকে মেয়রের পদ থেকে অপসারণ করা হয়, তা ভালোভাবে নেননি ভোটাররা। এবারের নির্বাচনে ঋণখেলাপির জামিনদার হওয়ায় তাঁর প্রার্থিতা বাতিল হয়। এসব কারণে ভোটারদের একটি অংশের মধ্যে জায়েদা খাতুনের প্রতি সহমর্মিতা কাজ করে থাকতে পারে। এ ছাড়া সরকারবিরোধী ভোটার যাঁরা ভোটকেন্দ্রে গেছেন, তাঁদের বেশির ভাগ ভোটই জায়েদা পেয়েছেন বলে ধারণা করা যায়।

সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, তফসিল ঘোষণার শুরু থেকেই আওয়ামী লীগের প্রার্থী প্রশাসনের কাছ থেকে নানা সহযোগিতা পেয়েছেন। অন্যদিকে বিরোধী প্রার্থীদের নির্বাচনী প্রচারণায় হামলা, বাধাদানের মতো ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়ায় ভোটাররা তাঁদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার সুযোগ পেয়েছেন।

নির্বাচনের আগে বুধবার রাতে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর ‘বাংলাদেশে ভোটের পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে’ নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে।

এই ভিসা নীতি অনুযায়ী নির্বাচনে অনিয়ম ও সুষ্ঠু নির্বাচনে বাধাদানকারী এবং তাদের নির্দেশদাতারা যুক্তরাষ্ট্রে ভিসা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হবেন। গাজীপুর সিটি নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার পেছনে এই ‘ভিসা নীতি’ কাজ করে থাকতে পারে।

জুন মাসে খুলনা, বরিশাল, রাজশাহী ও সিলেট—এই চার সিটিতে নির্বাচন অনু্ষ্ঠিত হবে। স্থানীয় সরকারের গুরুত্বপূর্ণ এই নির্বাচনে প্রার্থীরা যাতে বাধাহীন পরিবেশে প্রচারণা চালাতে পারেন এবং নির্বাচন যাতে সুষ্ঠু হয়, সেটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের (ইসি)।

গাজীপুর সিটি করপোরেশনে সুষ্ঠু ভোটের যে দৃষ্টান্ত স্থাপিত হলো, তার ধারাবাহিকতা চার সিটির নির্বাচনে বজায় থাকবে বলে আমরা আশা করি। চার সিটি করপোরেশনের নির্বাচন গ্রহণযোগ্যভাবে আয়োজন করা গেলে আগামী জাতীয় নির্বাচনের জন্য একটি অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হতে পারে।