সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়

দুর্নীতিবাজদের কেন উৎসাহিত করা হচ্ছে

মঙ্গলবার জাতীয় সংসদে পাস হওয়া ‘সরকারি চাকরি (সংশোধন) বিল-২০২৩’ যেমন বৈষম্যমূলক, তেমনি ন্যায়বিচারের সহায়ক নয়। এতে বলা হয়েছে, ‘স্বশাসিত সংস্থা, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান এবং স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত কর্মচারীদের বিরুদ্ধে দায়িত্ব পালনের সঙ্গে সম্পর্কিত কোনো মামলা হলে আদালতে অভিযোগপত্র গ্রহণের আগে তাঁদের কাউকে গ্রেপ্তার করতে হলে সরকার বা নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমতি লাগবে।’

এত দিন গ্রেপ্তার প্রশ্নে শুধু সরকারি কর্মচারীরা এই ছাড় পেয়ে আসছিলেন। তাঁদের সঙ্গে স্বশাসিত সংস্থা, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান এবং স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত কর্মচারীরাও যুক্ত হলেন।

কোনো সরকারি কিংবা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে দুর্নীতি-উৎকোচ গ্রহণের গুরুতর অভিযোগ এলে সেটাকে সরকারি দায়িত্ব পালনের সঙ্গে সম্পর্কিত বলে ছাড় দেওয়ার সুযোগ আছে বলে মনে হয় না।

গত ৪  এপ্রিল রাজশাহীতে ‘ঘুষের’ ১০ লাখ টাকাসহ একজন উপ-কর কমিশনারকে গ্রেপ্তার করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সংশোধিত সরকারি চাকরি আইন মানলে তো তাঁকে গ্রেপ্তারের আগে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতির প্রয়োজন হতো এবং সেই অনুমতির আগে অভিযুক্ত ব্যক্তি ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যেতেন।

সরকারি চাকরি (সংশোধন) বিল, ২০২৩-এ বলা হয়েছে, ২০১৮ সালের সরকারি চাকরি আইনের ১৫, ৪১, ৪২, ৪৩, ৪৪ ও ৪৫ ধারার বিধান স্বশাসিত সংস্থা, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান এবং স্থানীয় সরকারের অধীন প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত কর্মচারীদের জন্য প্রযোজ্য হবে। সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে আছে, সব নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয়লাভের অধিকারী। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম কেন হবে?

গত বছর ২৫ আগস্ট সরকারি চাকরি আইনের ৪১(১) ধারা সংবিধানের কয়েকটি অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে বাতিল ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। সরকারি কর্মচারীদের গ্রেপ্তারে কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমতি নেওয়ার বিধানসংক্রান্ত সরকারি চাকরি আইনের ধারা বাতিল করে দেওয়া হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সরকার লিভ টু আপিল (আপিল করার অনুমতি চেয়ে আবেদন) করার পর সেই আদেশের কার্যকারিতা স্থগিত আছে। সর্বোচ্চ আদালতে চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হওয়া পর্যন্ত সরকার অপেক্ষা করতে পারত।

এখানে দেখার বিষয় আইন সংশোধনের উদ্দেশ্য কী? সংশোধনের আগে যেসব সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ন্যায়ানুগভাবে দায়িত্ব পালন করতেন, তঁাদের কি কোনো সমস্যা হয়েছে? হয়নি। সমস্যা তাঁদেরই হয়েছে, যাঁরা দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে ধরা পড়েছেন।

সংশোধনীর বিষয়ে দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খানের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বলেন, বিচারাধীন থাকা অবস্থায় সরকারের এই আইনটি পাস করা ঠিক হয়নি। এর আগে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেছেন, সরকারি চাকরিতে অপরাধমূলক কাজ করা কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা খুবই কম। তাঁদের অপরাধের দায় বেশির ভাগ কর্মকর্তা-কর্মচারীর ওপর চাপানোর চেষ্টা লজ্জাজনক।

এই আইনে স্বশাসিত সংস্থা, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান এবং স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত কর্মচারীদের বেতন-ভাতা সরকারি কর্মচারীদের সঙ্গে সমন্বয়ের যে কথা বলা হয়েছে, সেটাকে আমরা স্বাগত জানাই। কিন্তু সরকারি কিংবা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের গ্রেপ্তারে পূর্বানুমতির বিষয়টি ন্যায়বিচারের সহায়ক নয়। 

সরকারের দাবি, অব্যাহতভাবে দুর্নীতি দমন, নিয়ন্ত্রণ, প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে দুদক প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। সংশোধিত আইন কেবল সেই উদ্দেশ্যই ব্যাহত করবে না, দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরই উৎসাহিত করবে।