কীটনাশকের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার যে ক্যানসারের মতো প্রাণঘাতী রোগের কারণ, এটা কোনো নতুন খবর নয়। সেই ২০১৩ সালেই জাতিসংঘের স্টকহোম কনভেনশনে কৃষিতে ব্যবহৃত ১২টি রাসায়নিককে তালিকাভুক্ত করে তাকে ‘ডার্টি ডজন’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। বলা হয়েছে, এই রাসায়নিক মেশানোর পর ভালো করে ধুলেও স্বাস্থ্যঝুঁকি থেকে যায়। কিন্তু মুশকিলটা হচ্ছে, ঘোষণার এক যুগ পরে এসেও দেখা যাচ্ছে কীটনাশকের যথেচ্ছ ব্যবহার চলছে। এই দোষ আসলে কার? কৃষকের, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর না বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের?
চুয়াডাঙ্গায় প্রথম আলোর প্রতিনিধির লেখা ‘কীটনাশক ব্যবহারে সতর্কতা কম’ প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, ওই জেলার কৃষকেরা কীটনাশক প্রয়োগে কোনো নির্দেশনা মানছেন না। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলেছে, কীটনাশক ব্যবহারের পর অন্তত ১ সপ্তাহ থেকে ১৫ দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করার পর শাকসবজি খাওয়ার উপযোগী হয়। কীটনাশকের গায়ে নির্দেশনাও লেখা থাকে। তবে তাতে কাজ হচ্ছে না। আর আইন থাকলেও চুয়াডাঙ্গায় নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ শাকসবজি পরীক্ষা করতে পারছে না। কারণ, তাদের প্রয়োজনীয় রি-এজেন্ট নেই। মাঠপর্যায়ে কৃষকেরা বলেছেন, কীটনাশক না দিলে শাকসবজিতে পোকা ধরে। ক্রেতা কিনতে চান না।
কোনো সন্দেহ নেই, বাংলাদেশের কৃষকেরা অসাধ্যসাধন করে চলেছেন। ৭ কোটি মানুষ নিয়ে যে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উদ্ভব, সেই দেশের জনসংখ্যা এখন ১৭ কোটি ছাড়িয়েছে। কৃষকও পাল্লা দিয়ে তাঁর উৎপাদন বাড়িয়েছেন। কিন্তু উৎপাদন বাড়াতে তাঁদের কীটনাশকের ওপর নির্ভরতাও বেড়েছে অনেক। কিন্তু পুষ্টির চাহিদা মেটাতে যে শাকসবজি মানুষের পাতে তাঁরা তুলে দিচ্ছেন, সেটা কতটা নিরাপদ, সে বিষয়টি তাঁদের বুঝতে হবে। কৃষকদের বিষয়টি বোঝানোর মূল দায়িত্ব কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক গত ডিসেম্বরে শাকসবজিতে কীটনাশকজনিত দূষণের মাত্রা ও স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে গবেষণা করেছেন। ওই প্রতিবেদনে তাঁরা লিখেছেন, দেশে এক দশকে সবজির উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৩৮ শতাংশ। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে কীটনাশকের ব্যবহার। তাঁরা বাজার থেকে যে নমুনা সংগ্রহ করেছেন, তার ২৯ শতাংশেই কীটনাশকের অবশেষ পাওয়া যায়। বিভিন্ন সূত্রকে উদ্ধৃত করে তাঁরা আরও বলেন, কীটনাশক থেকে স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদে স্বাস্থ্যঝুঁকি দেখা দেয়। বমি, চুলকানি, মাথা ঝিমঝিম করার মতো রোগের পাশাপাশি ক্যানসার, স্নায়ুতন্ত্রের রোগ, অ্যাজমা, বন্ধ্যত্ব ও ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজেসের মতো রোগও দেখা দেয়।
আমরা মনে করি, কৃষকদের কীটনাশকের যথেচ্ছ ব্যবহারের কুফল সম্পর্কে সচেতন করতে অধিদপ্তরের পাশাপাশি গণমাধ্যমের এগিয়ে আসা দরকার। কৃষিবিজ্ঞানীরা সমন্বিত বালাইনাশক পদ্ধতি ব্যবহারের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। এই প্রক্রিয়ায় ফসল বিনষ্টকারী জীবাণু চিহ্নিত সুনির্দিষ্ট জায়গায় কীটনাশক প্রয়োগ করা হয়। ভোক্তাদের ভূমিকাও নেহাত কম নয়। সর্বোপরি কীটনাশক কেনাবেচা ও প্রয়োগে কঠোর নজরদারি ভালো ফল বয়ে আনতে পারে।