নির্বাচন কমিশন (ইসি) বিদেশি পর্যবেক্ষক আনতে যতটা উদ্গ্রীব, রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীদের নির্বাচনী আচরণবিধি মানাতে ততটাই নিষ্ক্রিয়। সংবাদমাধ্যমগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার পরও তাদের এই অবস্থান কেবল প্রশ্নবিদ্ধ নয়, অগ্রহণযোগ্যও।
তফসিল অনুযায়ী আগামী ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে প্রার্থী ও দলের প্রচার শুরু হওয়ার কথা ১৮ ডিসেম্বর। কিন্তু এর আগেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র কেনার নামে ব্যক্তি ও দলের পক্ষে প্রচার চালিয়েছেন। কেউ কেউ ‘আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীদের নৌকা প্রতীকে ভোট দেওয়ার আহ্বান’সংবলিত প্ল্যাকার্ড নিয়েও মিছিল করেছেন। অনেকে এসেছেন বড় মিছিল ও মোটর শোভাযাত্রা নিয়ে। অথচ নির্বাচনী প্রচারের নির্ধারিত সময়ের আগে দলীয় প্রতীকে ভোট চাওয়াকে আচরণবিধি লঙ্ঘন নয় বলে মনে করে নির্বাচন কমিশন। তাদের যুক্তি হলো, এটা রিটার্নিং কর্মকর্তার অফিসের সামনে হয়নি। জাতীয় সংসদে নির্বাচনের যে আচরণ বিধিমালা ঘোষণা করা হয়েছে, সেটা শুধু প্রার্থী নয়; রাজনৈতিক দলের জন্যও প্রযোজ্য। এতে বলা আছে, কোনো নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল বা তার মনোনীত প্রার্থী বা তাদের পক্ষে কোনো ব্যক্তি ভোট গ্রহণের নির্ধারিত দিনের তিন সপ্তাহ আগে নির্বাচনী প্রচার শুরু করতে পারবে না।
বাস্তবতা হলো সরকারি দলের নেতা–মন্ত্রীরা বড় বড় সমাবেশ ডেকে বহুদিন আগে থেকে নৌকায় ভোট চাওয়া শুরু করেছেন। নির্বাচন কমিশন থেকে বলা হয়েছিল, তফসিল ঘোষণার আগে তাদের কিছু করার নেই। তফসিল ঘোষণার পর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এখন তারা আচরণবিধি ভঙ্গের ঘটনাগুলো দেখেও না দেখার ভান করছে। এমনকি পুলিশ কর্মকর্তা ভাইকে নিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের ক্ষমতাসীন দলের মনোনয়নপ্রত্যাশী এক নেতা ঢাকায় দলের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো–চেয়ারম্যানের সঙ্গে ফুলের তোড়া নিয়ে দেখাও করেছেন। এ নিয়ে নানা সমালোচনা তৈরি হয়েছে। নির্বাচন কমিশন যদি জেগে ঘুমিয়ে থাকে, তাহলে তাদের জাগাবে কে?
একজন নির্বাচন কমিশনার প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে রদবদল না করার পক্ষে এক হাস্যকর যুক্তি দাঁড় করিয়েছেন। তিনি বলেছেন, রদবদল করতে গেলে প্রশাসনে বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে। সংবিধানের ১২০ অনুচ্ছেদে আছে, ‘নির্বাচন কমিশনের ওপর ন্যস্ত দায়িত্ব পালনের জন্য যেরূপ কর্মচারীর প্রয়োজন হইবে, নির্বাচন কমিশন অনুরোধ করিলে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশনকে সেই রূপ কর্মচারী প্রদানের ব্যবস্থা করিবেন।’
গাইবান্ধা উপনির্বাচনের অনিয়ম–কারচুপির বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশন শক্ত ভূমিকা নিলে জনগণের মধ্যে এই ধারণা জেগেছিল যে তারা পূর্বসূরিদের পথে হাঁটবে না। স্বাধীন নির্বাচন কমিশন হিসেবে সংশ্লিষ্টদের আচরণবিধি মেনে চলতে যা যা প্রয়োজনীয়, তা করতে দ্বিধা করবে না। দুঃখজনক হলেও সত্য, সেই উপনির্বাচনেও যাঁরা অনিয়ম ও কারচুপির সঙ্গে জড়িত ছিলেন, ইসি তঁাদের কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেনি। এটা নির্বাহী বিভাগের কাছে তাদের আত্মসমর্পণই বটে।
নির্বাচন কমিশনের পদাধিকারীরা বলেছেন, নির্বাচনে কোন কোন দল অংশ নেবে, কোন কোন দল অংশ নেবে না; সেটি দেখার দায়িত্ব তাদের নয়। কিন্তু নির্বাচনে প্রতিযোগী দল ও প্রার্থীদের আচরণবিধি মানানোর দায়িত্ব তঁারা এড়াবেন কীভাবে?
নির্বাচন কমিশন আচরণবিধি মানানোর বিষয়ে যে উদাসীনতা দেখিয়ে আসছে, তাতে আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনী প্রচার শুরু হলে বিশৃঙ্খলা আরও বাড়বে। অবস্থা এমন হতে পারে, ইসি দল ও প্রার্থীদের ওপর খবরদারি করবে কী, তাদের ওপরই দল ও প্রার্থীরা খবরদারি করে যাবেন।