দেশজুড়ে স্থবিরতা

কোটা সংস্কারে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ও পরবর্তী সংঘর্ষ–সহিংস পরিস্থিতিতে গত বৃহস্পতিবার (১৮ জুলাই ২০২৪) সন্ধ্যার পর থেকে দেশজুড়ে ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়। মঙ্গলবার (২৩ জুলাই ২০২৪) রাত থেকে সীমিত আকারে ইন্টারনেট চালু করা হয়। এ কয়দিনের প্রথম আলোর ছাপা পত্রিকার সম্পাদকীয়, লেখা ও সাক্ষাৎকার ধাপে ধাপে অনলাইনে প্রকাশ করা হচ্ছে। মঙ্গলবার (২৩ জুলাই ২০২৪) এ সম্পাদকীয় ছাপা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।

গত রোববার সর্বোচ্চ আদালত সরকারি চাকরিতে ৯৩ শতাংশ মেধা ও ৭ শতাংশ কোটার ভিত্তিতে নিয়োগের নির্দেশনা দিয়েছেন। রায়ের পর আন্দোলনকারীদের অন্যতম নেতা হাসনাত আবদুল্লাহ ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ইন্টারনেট সংযোগ সচল করা, শিক্ষার্থীদের হল খুলে দেওয়া, সমন্বয়কদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ও কারফিউ প্রত্যাহার করার আহ্বান জানিয়েছেন। আমরাও মনে করি, পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য এই উদ্যোগগুলো গ্রহণ জরুরি। 

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা সরকারের কাছে সুনির্দিষ্ট কিছু দাবিনামা পেশ করেছেন। এর মধ্যে কোটা সংস্কারের পাশাপাশি অবিলম্বে বিশ্ববিদ্যালয় ও হল খুলে দেওয়া, আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা দেওয়া ও তাঁদের হয়রানি না করা, প্রতিটি খুনের ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া, সন্ত্রাসমুক্ত ক্যাম্পাস এবং নিহত ব্যক্তিদের পরিবারকে আর্থিক ক্ষতিপূরণের বিষয়টি অন্যতম। সংকট নিরসনে শিক্ষার্থীদের এসব দাবির ব্যাপারে সরকারকে অবশ্যই দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। 

গত শনি ও রোববার কারফিউর মধ্যেও দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। প্রথম আলোর খবর অনুযায়ী, পাঁচ দিনে মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৮৭। সরকারকে মনে রাখতে হবে, কারফিউ দিয়ে কোনো দেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনা যায় না। স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে হলে প্রথম সরকারকে সংকটের গভীরতা অনুধাবন করে সময়োচিত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। 

কোটা সংস্কারের আন্দোলনটি ছিল সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক। সরকারের কোনো কোনো মন্ত্রীর বক্তব্য-বিবৃতি এবং সরকার-সমর্থক ছাত্রসংগঠনটি মাঠে নামায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। যাঁরা কোটা সংস্কারের বিষয়টিকে আদালতের এখতিয়ার বলে দাবি করেছিলেন, আপিল বিভাগের রায় তাঁদের সেই দাবিকে অসার প্রমাণ করেছে।

আপিল বিভাগের রায়ের পর সরকারের নীতিনির্ধারকদের উচিত হবে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আস্থা তৈরি করা। আন্দোলনকারীদের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি কিংবা তাঁদের ভয়ভীতি দেখানো হলে আর যা–ই হোক পরিস্থিতির উন্নতি হবে না। ইতিমধ্যে কোটা সংস্কার আন্দোলনের একজন সমন্বয়ক মো. নাহিদ ইসলামকে বাসা থেকে তুলে নেওয়া এবং তাঁর ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালানোর অভিযোগ উঠেছে। অনতিবিলম্বে এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও দায়ী ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনতে হবে। 

ইতিমধ্যে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ঢাকাসহ সারা দেশে অনেক প্রাণহানি হয়েছে। আহতদের অনেকের অবস্থাও গুরুতর। রাষ্ট্রীয় সম্পদের প্রভূত ক্ষতিসাধন হয়েছে। এসব অপ্রত্যাশিত ঘটনা কোনোভাবেই আর বাড়তে দেওয়া যায় না। যেখানে সরকার স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার ঘোষণা দিয়েছে, সেখানে এক মিনিটের জন্যও ইন্টারনেট সেবা বন্ধ থাকতে পারে না। অথচ কয়েক দিন ধরে ইন্টারনেট সেবা বন্ধ থাকায় শুধু ব্যবসা-বাণিজ্যের চরম ক্ষতি হচ্ছে না, নাগরিকেরাও পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাসসহ অন্যান্য সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে ভোগান্তির মুখে পড়েছে। বাংলাদেশ কার্যত পুরো বিশ্ব থেকে ডিজিটাল পরিসরে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। 

গত কয়েক দিনের সহিংসতা, অস্থিরতা ও কারফিউয়ে অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়েছে। আমদানি-রপ্তানিতে কার্যত অচলাবস্থা চলছে, বন্ধ হয়ে গেছে কারখানার উৎপাদন। শীর্ষ ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো উদ্বেগ ও শঙ্কা জানিয়ে দ্রুত সংকট নিরসনের আহ্বান জানিয়েছে। সরবরাহে ঘাটতির কারণে ঢাকায় সবজি, ডিমসহ নিত্যপণ্যের দাম আরও এক দফা চড়েছে। অন্যদিকে বিপুলসংখ্যক শ্রমজীবী মানুষের রুটি–রুজির অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। 

দেশজুড়ে যে স্থবিরতা তৈরি হয়েছে তা থেকে বেরিয়ে আসতে, জনজীবনে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে এবং অর্থনীতির চাকা সচল করতে অবিলম্বে ইন্টারনেট সেবা চালু ও কারফিউ প্রত্যাহার করা প্রয়োজন।