নিমতলী-বেইলি রোডের আগুন

সম্মিলিত গাফিলতির দায় নেবে কে

ফেব্রুয়ারির শেষ দিনটা (২৯ ফেব্রুয়ারি) আরেকটি মর্মান্তিক অগ্নিকাণ্ড ও প্রাণহানির সাক্ষী হলো রাজধানী ঢাকা। এ ঘটনা সম্মিলিত গাফিলতিতে কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড, অবহেলাজনিত মৃত্যুর আরেকটি ধ্রুপদি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। কেননা, বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ নামের বহুতল ভবনটিতে যে আগুনের ঝুঁকি ছিল, তা জানত সরকারি সংস্থা। তিনবার চিঠি দেওয়ার পরও তা আমলে নেননি ভবনমালিক। বাণিজ্যিক ও আবাসিকের অনুমোদন নিয়ে সেখানে রেস্তোরাঁ বা পণ্য বিক্রয়কেন্দ্র করা হয়। ভবনটিতে একটি সিঁড়ি থাকলেও ছিল না অগ্নিনির্গমন পথ। সংকীর্ণ সেই সিঁড়িতেও ছিল গ্যাস সিলিন্ডারসহ নানা প্রতিবন্ধকতা। কাচঘেরা ভবনটিতে বাতাস ও ধোঁয়া বের হওয়ারও কোনো পথ ছিল না। আর ছাদেও রেস্তোরাঁ থাকায় সেখানেও ফাঁকা জায়গা ছিল সামান্য।

এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে অনিয়ম ও গাফিলতির পাহাড় জমতে জমতে বেইলি রোডের বহুতল ভবনটি মৃত্যুকূপে পরিণত হয়েছিল। মর্মান্তিক এই অগ্নিকাণ্ডে এ পর্যন্ত নারী, শিশুসহ ৪৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। প্রশ্ন হলো গণপূর্ত, রাজউক, সিটি করপোরেশন, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর—সবার চোখের সামনেই বছরের পর বছর ধরে দিব্যি সেখানে এ রকম নিরাপত্তাহীন পরিবেশে অনুমোদনহীন রেস্তোরাঁ ব্যবসা চলছিল? একটা ভবন নির্মাণের আগে যে উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হবে, তার জন্য অনুমোদন নিতে হয় এবং সে অনুযায়ী নকশা করতে হয়। আবাসিক কিংবা বাণিজ্যিক ভবনে রেস্তোরাঁ করার কোনো সুযোগ নেই। কেননা রেস্তোরাঁর রান্নাঘরের জন্য বিশেষ ব্যবস্থার দরকার হয়।   

গ্রিন কোজি কটেজে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ও মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনা সবচেয়ে জরুরি যে প্রশ্নটি সামনে নিয়ে এসেছে, তা হলো বেইলি রোড, ধানমন্ডি, সাতমসজিদ রোড, বনানীসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বহুতল ভবনে ব্যাঙের ছাতার মতো অসংখ্য রেস্তোরাঁ গড়ে উঠেছে, সেগুলোর অনুমোদন কি রয়েছে? বেইলি রোডে অগ্নিকাণ্ডে প্রাণহানির ঘটনাকে অবহেলাজনিত ধারাবাহিক হত্যাকাণ্ডের দৃষ্টান্ত বলে সতর্ক করে দিয়ে স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেছেন, ঢাকার অনেক বাণিজ্যিক ভবনে যেভাবে বিভিন্ন তলায় রেস্তোরাঁ তৈরি করা হয়েছে, তাতে মূলত ভবনগুলো ‘টাইম বোমা’য় পরিণত হয়েছে। 

এই সতর্কতাকে সরকার আমলে নিচ্ছে নাকি আরেকটি টাইম বোমা বিস্ফোরণের জন্য অপেক্ষা করবে—সেটাই এখন দেখার বিষয়। নিমতলী থেকে চুড়িহাট্টা, বনানীর এফআর টাওয়ার থেকে বঙ্গবাজার—গত এক যুগে ঢাকায় অনেকগুলো ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। সব কটির ক্ষেত্রেই সম্মিলিত গাফিলতির চিত্র বেরিয়ে এসেছে। প্রতিবারই তদন্ত কমিটি হয়েছে, তারা সুপারিশও দিয়েছে। কিন্তু তার বাস্তবায়ন হয়েছে সামান্যই। ২০১৯ সালে বনানীর এফআর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডের পর রাজউক বহুতল ভবনে অগ্নিনিরাপত্তাব্যবস্থার তথ্য সংগ্রহ করে। সংস্থাটি আওতাধীন এলাকায় ১০ তলার ওপর ভবন পায় ১ হাজার ৮১৮টি, যার ১ হাজার ১৫৫টিতেই অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র নেই। এই ভবনগুলোর বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নিয়েছে রাজউক? 

বিশ্বের অন্যতম জনবহুল নগর ঢাকা এতটাই অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে যে এখানে পরিকল্পিত নগরায়ণ করা অত্যন্ত কঠিন। কিন্তু নাগরিকের জীবন ও তাদের সম্পদের নিরাপত্তার জরুরি বিষয়টি কেন উপেক্ষা করা হবে?

নিমতলী থেকে বেইলি রোড—একের পর এক অগ্নিকাণ্ড এবং এত মানুষের মৃত্যুর দায় কার? একটি ভবন গড়ে ওঠা থেকে শুরু করে এর কার্যক্রম চলা পর্যন্ত বিভিন্ন ধাপের সঙ্গে সরাসরি ছয়টি সংস্থা যুক্ত থাকে। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), সিটি করপোরেশন, পরিবেশ অধিদপ্তর, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। ফলে ভবনমালিক, দোকানমালিক থেকে শুরু করে সরকারের ছয়টি সংস্থার কেউই এসব অগ্নিকাণ্ড ও অবহেলাজনিত মৃত্যুর দায় এড়াতে পারেন না। জবাবদিহি ও শাস্তি—কোনোটার দৃষ্টান্ত স্থাপিত না হওয়ায় সবখানেই গাফিলতি ও দায়হীনতার সংস্কৃতি জেঁকে বসেছে। 

সব সংস্থার দায় থাকার মানে হচ্ছে কারোরই কোনো দায় না থাকা কিংবা অপরের ঘাড়ে দায় চাপিয়ে চুপচাপ বসে থাকা। সরকারি সংস্থাগুলোর সম্মিলিত গাফিলতি থেকে তাহলে কি মুক্তির পথ নেই? এভাবেই কি একের পর এক মর্মান্তিক অগ্নিকাণ্ডে নাগরিকেরা পুড়ে আর শ্বাসরোধে মরতেই থাকবে?