সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়

অকার্যকর নির্বাচন কমিশন

আরেকটি ইচ্ছাপূরণের নির্বাচন?

আরেকটি একতরফা নির্বাচনের ঝুঁকি নিয়েই নির্বাচন কমিশন তফসিল ঘোষণা করেছে। এ ক্ষেত্রে তারা সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা ও নিজেদের সাংবিধানিক দায়িত্বের দোহাই দিয়েছে। কিন্তু তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচন কমিশনের যে আরও কিছু সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা আছে, সেদিকে তাদের আদৌ কোনো নজর আছে বলে মনে হয় না।

অতীতের নির্বাচন কমিশনের মতো বর্তমান নির্বাচন কমিশনের পদাধিকারীরাও দায়িত্ব নেওয়ার পর আশ্বাস দিয়েছিলেন যে তাঁরা সুষ্ঠু, অবাধ, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করবেন। এ জন্য তাঁরা দফায় দফায় রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন মহলের সঙ্গে বৈঠক করেছেন, কর্মপরিকল্পনা তৈরি করেছেন।

কিন্তু দিন শেষে দেখা যাচ্ছে, তাঁরা পূর্বসূরি কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ ও কে এম নূরুল হুদা কমিশনের পথেই হাঁটছেন। বর্তমান কমিশনের অধীনে এ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত অধিকাংশ নির্বাচনই চরমভাবে বিতর্কিত হয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের কার্যকর কোনো উদ্যোগ না নিয়েই জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে।

নিয়ম অনুয়ায়ী তফসিল ঘোষণার পর পুলিশ ও প্রশাসনের ওপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা এবং নির্বাচনের আচরণবিধির দিকে নজর রাখা কমিশনের দায়িত্ব। ১৫ নভেম্বর তফসিল ঘোষণার পর আগের জনপ্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনই বহাল আছে। নির্বাচন নিয়ে যে রাজনৈতিক সংকট চলছে, তা সমাধান করা নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব না হলেও নিজেদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব এড়াতে পারে না।

তফসিল ঘোষণার পর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নির্বাচনী আইনকানুন মানতে বাধ্য করার ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন কোনো পদক্ষেপ নিয়েছে, এমন দৃষ্টান্ত নেই। নির্বাচন কমিশন সাড়ম্বরে ডিজিটাল পদ্ধতিতে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার অ্যাপ চালু করে আহ্লাদিত হয়েছিল। তারা বলেছিল, এর মাধ্যমে মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন রোধ করা যাবে।

কিন্তু আমরা বিস্ময়ের সঙ্গে দেখলাম, মনোনয়ন ফরম বিক্রি নিয়ে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলটি রাস্তা বন্ধ করে যে মনোনয়ন ফরম বিক্রি করেছে, মনোনয়নপ্রত্যাশীরা বিশাল বিশাল ব্যানার নিয়ে মিছিল করে দলীয় কার্যালয়ে গেছেন। এসব দেখেও কমিশন না দেখার ভান করছে। এসব সাংবিধানিক দায়িত্ব তারা পালন করছে না।

নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে সরকার তাদের ছক অনুযায়ী জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের কর্মকর্তাদের ব্যাপকভাবে রদবদল করেছে। আশা করা গিয়েছিল, তফসিলের পর কমিশন পুরো বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। কিন্তু তারা এখন বলছে, পুলিশ ও প্রশাসনে রদবদল আনলে বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে।

সে ক্ষেত্রে তফসিল ঘোষণার আগের ও পরের পরিস্থিতির কোনো পার্থক্য নেই। সংবিধানের ১২০ অনুচ্ছেদে আছে, ‘নির্বাচন কমিশনের ওপর ন্যস্ত দায়িত্ব পালনের জন্য যেরূপ কর্মচারীর প্রয়োজন হইবে, নির্বাচন কমিশন অনুরোধ করিলে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশনকে সেইরূপ কর্মচারী প্রদানের ব্যবস্থা করিবেন।’

কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, সরকার যেরূপ প্রশাসন সাজিয়ে রেখেছে, নির্বাচন কমিশন সেরূপ প্রশাসন দিয়েই নির্বাচন করতে চাইছে। নির্বাচন কমিশনার রাশেদা সুলতানা বিএনপির প্রতি ইঙ্গিত করে বলেছেন, ওনারা নির্বাচনে এলে তঁাদের জন্য স্পেস বা জায়গা তৈরি করা হবে। এটা কি জায়গা তৈরি করার নমুনা?

নির্বাচন কমিশনের কার্যক্রমে মাঠ সমতল করার কোনো লক্ষণ নেই। ক্ষমতাসীন দল ও তাদের সঙ্গীরা যখন মনোনয়নপত্র দাখিল করা নিয়ে তোড়জোড় করছে, তখন বিরোধী দলের অফিসে তালা ঝুলছে। এ অবস্থায় নির্বাচন কমিশন যে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে, সেটি ইচ্ছাপূরণের নির্বাচনই হবে। বিএনপি যদি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে আসতে রাজিও হয়, তাহলেও এই অসমতল মাঠে সুষ্ঠু ভোট করা কঠিন হবে। নির্বাচন কমিশন যেভাবে সব বিষয়ে নিষ্ক্রিয়তা দেখাচ্ছে, তাতে নিয়ম রক্ষার একটি ভোটই হতে পারে; জনরায়ের প্রতিফলন ঘটবে, এটা বলা যায় না।