সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়

রপ্তানির হিসাবে গরমিল

দায়ীদের জবাবদিহির আওতায় আনা হোক

দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলো যদি সমন্বিতভাবে কাজ না করে, যদি কোনো প্রতিষ্ঠান ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো খাতের ভুল হিসাব তুলে ধরে, তার নেতিবাচক প্রভাব প্রবৃদ্ধি তথা অর্থনীতির প্রতিটি সূচকে যে পড়বে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

সম্প্রতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ের ব্যালান্স অব পেমেন্টের (বিওপি) তথ্য প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে আলোচ্য অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে দেশের রপ্তানি আয় দেখানো হয়েছে ৩৩ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলার। যদিও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, এ সময়ে রপ্তানি আয় হয়েছে ৪৭ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন ডলার। এ ক্ষেত্রে ইপিবির দেওয়া পরিসংখ্যান থেকে ১৩ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলার বাদ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পাশাপাশি সংশোধন করা হয়েছে আগের অর্থবছরের একই সময়ের রপ্তানির পরিসংখ্যানও।

জিডিপির আকার, প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয়সহ অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ সূচকগুলো পরিমাপের অন্যতম অনুষঙ্গ হলো রপ্তানি আয়ের তথ্য। সংশোধনের মাধ্যমে রপ্তানি আয় কমে আসায় দেশের জিডিপির আকার, প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয়সহ এসব সূচকে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে সম্প্রতি রপ্তানি আয়ের তথ্যে পরিবর্তনের বিষয়টি অর্থ ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে চিঠির মাধ্যমে অবহিত করা হয়। এতে বলা হয়, ইপিবির পরিসংখ্যানে একই রপ্তানি তথ্য এবং পণ্যের এইচএস কোড একাধিকবার ইনপুট দেওয়া হয়েছে। পণ্যের কাটিং, মেকিং ও ট্রিমিংয়ের ক্ষেত্রে শুধু তৈরির মাশুল পাওয়ার কথা। কিন্তু ইপিবি কাপড়সহ সব যন্ত্রাংশের হিসাব করেছে। ইপিবি অনেক সময় নমুনা পণ্যের দামও ইনপুট দিয়েছে। অথচ নমুনা পণ্যের কোনো দাম হিসাবে আসার কথা নয়।

অর্থনীতিবিদদের মতে, রপ্তানি আয়ের হিসাব পরিবর্তনের ফলে সামষ্টিক অর্থনীতির প্রায় সব ধরনের সূচকেই পরিবর্তন আসবে। রপ্তানির তুলনায় আমদানির হিসাবে পরিবর্তন না হওয়ায় বাণিজ্য–ঘাটতি বাড়বে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও কমে আসবে।

বিওপির অনেক খাতেই রপ্তানি আয় থেকে প্রায় ১৪ বিলিয়ন ডলার বাদ পড়ে যাওয়ার প্রভাব পড়েছে। মার্চ পর্যন্ত বিওপিতে দেশের বাণিজ্য–ঘাটতি দেখানো হয়েছিল মাত্র ৪ দশমিক ৭৪ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু এপ্রিলে এসে এ ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১৮ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলারে। এক ধাক্কায় বাণিজ্য–ঘাটতি প্রায় চার গুণ বেড়ে যাওয়ার প্রভাবে উদ্বৃত্ত থেকে ঘাটতিতে রূপ নিয়েছে চলতি হিসাবের ভারসাম্য। একজন রপ্তানিকারক প্রথম আলোকে বলেন, প্রতি মাসে ১ বিলিয়ন বা ১০০ কোটি মার্কিন ডলারের বেশি রপ্তানি দেখিয়ে আসছিল ইপিবি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা মনে করেন, এত দিন রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো বা ইপিবির রপ্তানি ধরে হিসাব করা হতো। কিন্তু হিসাব অনুযায়ী দেশে রপ্তানি আয় আসছিল না। এ নিয়ে দেশি ও বিদেশি নানা সংস্থা থেকেও প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে। এখন থেকে প্রকৃত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে প্রতিবেদন তৈরি করা হবে।

আমরা আশা করব, সরকার রপ্তানির হিসাবের এই বিচ্যুতির বিষয়টি যথাযথভাবে তদন্ত করে দেখবে এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জবাবদিহির আওতায় আনবে। খতিয়ে দেখতে হবে, ভুলটি ইচ্ছাকৃত কি না। অনেক সরকারি কর্মকর্তাই অর্থনীতির উজ্জ্বল চিত্র তুলে ধরে নীতিনির্ধারকদের কাছ থেকে বাহবা নিতে চান। অথচ এ ধরনের ভুলের মাশুল দিতে হয় জনগণকেই।

ব্যবসায়ীরা ইপিবির রপ্তানির হিসাবের সঙ্গে একমত ছিলেন না। গবেষণাপ্রতিষ্ঠানগুলো হিসাবের গরমিল নিয়ে বিভিন্ন সময় প্রশ্ন তুলেছে। কিন্তু সরকারের নীতিনির্ধারকেরা বরাবর আমলাদের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন। ইপিবির হিসাবের শুভংকরের ফাঁকি ধরা পড়ার পর সরকার সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়, সেটাই দেখার বিষয়।