সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা

বিচারহীনতার সংস্কৃতির অবসান হোক

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার ঘটনায় করা এক মামলায় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক দুই চেয়ারম্যানসহ ১৩ জনকে চার বছর করে কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। বৃহস্পতিবার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মাসুদ পারভেজ এ রায় দেন। নাসিরনগরে হামলার প্রায় সাড়ে ছয় বছর পর এ ঘটনায় কোনো মামলার রায় হলো। বাকি সাতটি মামলা বিচারাধীন।

দণ্ডপ্রাপ্ত সাবেক দুই চেয়ারম্যান স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা। তাঁদের মধ্যে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সদর ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান শেখ মো. আবদুল আহাদ বর্তমানে কারাগারে। হরিপুর ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান দেওয়ান আতিকুর রহমান পলাতক। 

 ২০১৬ সালের ৩০ অক্টোবর নাসিরনগর উপজেলা সদরের পশ্চিমপাড়ায় পুরোনো দুর্গামন্দিরে অগ্নিসংযোগ করে দুর্বৃত্তরা। এতে মন্দিরের অধিকাংশ জিনিস পুড়ে যায়। একই সময় উপজেলার ঠাকুরপাড়ার কেশব চক্রবর্তীর বাড়িতে আগুন দেওয়া হয়। ২০২১ সালে ১৩ জনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। বিলম্বে হলেও একটি মামলার বিচার হয়েছে, এটা স্বস্তির খবর। আমরা এ রায়কে স্বাগত জানাই।

অপরাধের শাস্তি নিশ্চিত করা আইনের শাসনের অন্যতম পূর্বশর্ত। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, এর আগে বাংলাদেশে বিভিন্ন সময় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর অনেক হামলার ঘটনা ঘটলেও বিচারের দৃষ্টান্ত খুবই কম। আমাদের পূর্বাপর সরকারগুলো সাম্প্রদায়িক সহিংসতার দায় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর চাপাতেই অতিশয় উদ্‌গ্রীব। ২০১২ সালে কক্সবাজারের রামুতে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ওপর হামলায় অনেক বাড়িঘর ও মন্দির ধ্বংস হলেও কেউ শাস্তি পাননি। বলা হচ্ছে সাক্ষীর অভাবে বিচারকাজ শেষ করা যাচ্ছে না। ২০২১ সালে কুমিল্লায় একটি মন্দিরে কোরআন শরিফ রাখাকে কেন্দ্র করে অনেক স্থানে মন্দির ও হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে হামলা হয়েছে। অথচ গত দেড় বছরেও মামলাগুলোর তদন্তের কাজ শেষ করতে পারেননি দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা।  

নাসিরনগরের সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনায় অন্তত একটি মামলার বিচার হয়েছে। এতে আক্রান্ত সংখ্যালঘুদের মনে এ আস্থা জন্মাবে যে ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার তাঁদেরও আছে। নাসিরনগরের ঘটনায় যঁারা দণ্ডিত হয়েছেন কেবল তাঁরাই অপরাধী, না নেপথ্যে আরও কেউ আছেন, সেটাও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনা নিয়ে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা না করে সরকারের উচিত অপরাধীদের খুঁজে বের করে শাস্তি নিশ্চিত করা। অপরাধী যে দলেরই হোক না কেন, বিচারের আওতায় আনা হবে—এসব কথা মুখে বললেই হবে না, কাজেও প্রমাণ দিতে হবে। 

নাসিরনগরের সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনায় যাঁদের শাস্তি হয়েছে, তাঁদের মধ্যে পাঁচজন এখনো পলাতক। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উচিত যত দ্রুত সম্ভব তঁাদের খুঁজে বের করা। মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তির আগে বলা যাবে না অপরাধীরা শাস্তি পাচ্ছেন। বিবাদীপক্ষের আইনজীবী ইতিমধ্যে আপিল করার কথা বলেছেন। সে ক্ষেত্রে সরকারপক্ষের কর্তব্য হবে দ্রুত যাতে আপিল নিষ্পত্তি হয়, সেই ব্যবস্থা করা। বিচারহীনতার সংস্কৃতির অবসান হোক।

 রসরাজ দাস নামের যে গরিব জেলের ফেসবুকের পোস্টের জেরে নাসিরনগরে হামলার ঘটনা ঘটেছে, তাঁর বিরুদ্ধে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনে করা মামলাটি এখনো চলমান। তাঁকে প্রতি মাসে আদালতে হাজিরা দিতে চট্টগ্রামে যেতে হয়। সিআইডির প্রতিবেদনে যখন প্রমাণিত হয়েছে ফেসবুক পোস্টটি তাঁর নয়, তখন এ মামলা চলার কী যুক্তি থাকতে পারে?