সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়

চলনবিলে খাল কেনাবেচা

খাল কি প্রভাবশালীদের জন্য উপহার

রবি মারান্ডি (২৭) ও অভিনাথ মারান্ডি (৩৬) নামের দুই কৃষকের কথা মনে আছে? বরেন্দ্র অঞ্চলের এই দুই ভাই সেচের পানি না পেয়ে কীটনাশক পান করে আত্মহত্যা করেন বছর দুয়েক আগে। জনসাধারণের মনে থাকলেও যাঁরা সরকারি সম্পদকে পৈতৃক সম্পত্তি বলে মনে করেন, তাঁদের নির্ঘাত মনে নেই। মনে থাকলে তাঁরা সরকারি টাকায় কাটা খাল দখল করে টাকার বিনিময়ে ইজারা দিতেন না।

প্রথম আলো খবর ছেপেছে, নাটোরের স্থানীয় প্রভাবশালীরা চলনবিলের খাল কেনাবেচা করছেন। গত তিন অর্থবছরে সরকারি অর্থায়নে চলনবিলের নাটোরের সিংড়া উপজেলা অংশে ১৫৪ কিলোমিটার খাল খনন ও পুনঃখনন করা হয়েছিল। বর্ষা মৌসুমে এসব খাল চলনবিলের সঙ্গে মিশে যায়। মৌসুম শেষে বিলের পানি খাল হয়ে নদীতে মেশে। বিলের মাছ তখন খালে আশ্রয় নেয়। সরকার নিয়ম করে দিয়েছে, খাল না শুকিয়ে জেলেরা মাছ ধরতে পারবেন। তা ছাড়া বোরো ধানের খেতেও যাবে পানি।

কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, ক্ষমতাসীন দলের লোকজন ইচ্ছেমতো খাল থেকে পানি সেচে ফেলে দিয়ে ইজারা দিচ্ছেন। জেলেরাও পেটের টানে টাকা খরচ করে ইজারা নিচ্ছেন। আর বোরোর খেত থেকে যাচ্ছে শুকনা। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন খাল বেদখলের খবর দিয়েছে সংশ্লিষ্ট সব সরকারি কার্যালয়কে। তারাও নাকি অভিযান চালাচ্ছে; যদিও অভিযানের ফল এখনো দৃশ্যমান নয়।

খাল কেনাবেচায় যাঁরা জড়িত, তাঁরা লুকিয়ে নেই। তাঁরা অপরাধ করছেন বুক ফুলিয়ে। বোঝাই যাচ্ছে, রাজনৈতিক পরিচয় তাঁদের এই দুঃসাহস দিয়েছে। খাল দখলকারীদের মধ্যে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের নেতারা আছেন। তাঁরা ধরেই নিয়েছেন, কোনো আইনকানুনই তাঁদের স্পর্শ করবে না। যদিও পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো বারবার বলছে, খাল থেকে পানি সেচে এভাবে মাছ ধরতে থাকলে আর মাছ পাওয়া যাবে না। যাঁরা খালের পানি সেচে মাছ ধরছেন, তাঁরা জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকি।

আমরা কি তাহলে ধরে নেব, ১৭ কোটি টাকা ব্যয়ে ৩ বছর ধরে ১৫০ কিলোমিটারের ওপরে যে খাল খনন করা হয়েছে, তা আসলে কৃষক-জেলেদের জন্য নয়? দলীয় প্রভাবশালীরা সেটাকে তাদের জন্য দেওয়া সরকারের উপহার বলে মনে করছে।

ভূগর্ভস্থ পানির যথেচ্ছ ব্যবহার এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বরেন্দ্র অঞ্চলে তীব্র পানির সংকট দেখা দিয়েছে। এই গত বছরই ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং (আইডব্লিউএম) এক গবেষণায় দেখেছে, ১৯৮৫ ও ১৯৯০ সালে বরেন্দ্র এ অঞ্চলের গড় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ছিল ৮ মিটার।

২০২১ সালে এসে এই স্তর গড়ে ১৮ মিটারে বৃদ্ধি পায় এবং কিছু কিছু এলাকা, যেমন চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুরের একটি স্থানে সর্বোচ্চ ৪৬ দশমিক ৮৭ মিটার পর্যন্ত। এমন প্রেক্ষাপটে খাল কেটে পানির চাহিদা কিছুটা পূরণের চেষ্টা চলছে। কথায় বলে, ‘বেড়ায় খেত খায়।’ নাটোরে খাল কেনাবেচা সেই প্রবাদই মনে করাল।