যেখানে মানুষের কাজের সুযোগ সীমিত, সেখানে কর্মস্থলে নিরাপত্তা নিয়ে ভাবার সুযোগ কম। বিকল্প জীবিকা না থাকায় অনেকে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ পেশা বেছে নেন বা নিতে বাধ্য হন। কর্মস্থলে নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব মূলত নিয়োগদাতা সংস্থার।
বাংলাদেশ অকুপেশনাল সেফটি, হেলথ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট (ওশি) ফাউন্ডেশনের জরিপে দেখা যায়, এ বছর কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় ১ হাজার ৪৩২ জনের মৃত্যু হয়েছে, যা গত বছর ছিল ৯৬৭ জন। অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় এ বছর দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু ৪৮ শতাংশ বেড়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, চলতি বছর কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ১ হাজার ১০৩ জন অপ্রাতিষ্ঠানিক এবং ৩২৯ জন প্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরত ছিলেন। এর মধ্যে পরিবহন খাতে সর্বোচ্চ ৬৩৭ জন শ্রমিক নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া দিনমজুর খাতে ২২০ জন, নির্মাণ খাতে ১৪৯ জন, কৃষি খাতে ১৪৬ জন, উৎপাদন খাতে ৯৪ জন, পোশাক খাতে ৬৪ জন, মৎস৵ খাতে ৫৩ জন, সেবা খাতে ২৬ জন, সিরামিক খাতে ১৭ জন এবং অন্যান্য খাতে ২৬ জনের মৃত্যু হয়েছে।
ওশি ফাউন্ডেশন বলেছে, বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ (সংশোধিত ২০১৮) এবং বাংলাদেশ শ্রম বিধিমালা ২০১৫-তে উল্লেখিত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তাসংশ্লিষ্ট নির্দেশনার যথাযথ প্রয়োগের অভাব এবং প্রশিক্ষণবিহীন চালক নিয়োগের কারণে পরিবহন খাতে দুর্ঘটনার সংখ্যা ও হতাহতের ঘটনা বাড়ছে।
ফাউন্ডেশন দুর্ঘটনা রোধে আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করা, মালিক ও শ্রমিকপক্ষের সমন্বয়ে সেফটি বা নিরাপত্তা কমিটি গঠন, কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা রোধে মালিক ও শ্রমিকের সমন্বয়ে কমিটি গঠনের পাশাপাশি নিহত শ্রমিককে এককালীন ১০ ও ৫ লাখ টাকা দেওয়ারও সুপারিশ করেছে। ওশির এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন করা কঠিন নয়। নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো কর্মস্থলে কর্মীদের উপযুক্ত নিরাপত্তা দিলে দুর্ঘটনার হার অনেকে কমে আসবে। আর দুর্ঘটনা না ঘটলে মালিকদের মোটা অঙ্কের ‘ক্ষতিপূরণও’ দিতে হবে না।
ওশি ফাউন্ডেশন সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে কর্মস্থলে হতাহতের পরিসংখ্যান দিয়েছে। এর বাইরেও অনেক দুর্ঘটনা ঘটে, যার তথ্য সংবাদমাধ্যমে আসে না। সে ক্ষেত্রে কর্মস্থলে দুর্ঘটনায় প্রকৃত মৃত্যুর সংখ্যা অনেক বেশি হবে। বিশেষ করে অপ্রাতিষ্ঠানিক কাজ করতে গিয়ে যাঁরা মারা যান, তাঁদের খবর কেউ রাখেন না। আবার অনেক সময় গৃহকর্মীরা নির্যাতনে মারা গেলেও আত্মহত্যা বা স্বাভাবিক মৃত্যু বলে চালানো হয়। গত শনিবার বনশ্রীতে এক বাসায় গৃহকর্মীর মৃত্যু নিয়ে সেখানে গাড়িতে আগুন দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।
কর্মস্থলে দুর্ঘটনা রোধ করতে হলে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তাব্যবস্থা থাকা জরুরি। যেসব কাজ অধিক ঝুঁকিপূর্ণ, সেসব কর্মস্থলে বাড়তি নিরাপত্তাব্যবস্থার বিকল্প নেই। বিশেষ করে আমাদের দেশে এখনো উঁচু ভবন নির্মাণ করা হয় সেকেলে পদ্ধতিতে; যেখানে দুর্ঘটনার হার অনেক বেশি।
ওশির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, পরিবহন খাতে সর্বোচ্চ ৬৩৭ জন শ্রমিক নিহত হয়েছেন। বেপরোয়া গাড়ি চালনার জন্যই বেশি দুর্ঘটনা ঘটে। এ ক্ষেত্রে শ্রমিকদের পাশাপাশি মালিকদেরও দায় আছে। অনেক মালিক চালকদের অতিরিক্ত সময় গাড়ি চালাতে বাধ্য করেন, যা দুর্ঘটনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
কর্মস্থলে দুর্ঘটনায় মৃত্যু পুরোপুরি বন্ধ করা না গেলেও সমন্বিত উদ্যোগ নিলে এবং সব পক্ষ আইন মেনে চললে মৃত্যুর হার অনেক কমিয়ে আনা সম্ভব। আর সে ক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় মৃত্যুর প্রতিটি ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত এবং দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে।