এবার যখন সরকার সরকারি খরচে কাউকে হজে না পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিল, তখন দেশবাসীর সঙ্গে আমরাও খুশি হয়েছিলাম এই ভেবে যে বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটের সময় সরকারের কিছু বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হলো। গত বছরও ২৫৪ জনকে সরকারি খরচে হজে পাঠানো হয়েছিল, যাঁদের মধ্যে ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারী, রাজনীতিক, সাংবাদিক ও মসজিদের ইমাম। সরকারি খরচে হজে না পাঠানোর এই সিদ্ধান্ত সব মহলে প্রশংসিতও হয়েছিল।
এই প্রেক্ষাপটে সম্প্রতি যে খবরটি আমাদের বিস্মিত করেছে, তা হলো হজযাত্রীদের সহায়তা করতে সরকার ২১৮ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল পাঠাচ্ছে। হজযাত্রীদের চিকিৎসাসেবা ও আনুষঙ্গিক কাজে সহায়তার প্রয়োজন আছে। সে জন্য সরকার চিকিৎসক ও নার্সদের সমন্বয়ে মেডিকেল টিম পাঠাতে পারে। এমনকি হজযাত্রীদের দেখাশোনার জন্য সহায়তাকারীও পাঠাতে পারে। কিন্তু যাঁদের সঙ্গে এসব সহায়তা করার সম্পর্ক নেই কিংবা যাঁরা সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও কর্মচারী, তাঁদের পাঠানোর যৌক্তিকতা কী। এটাকে বেনামে সরকারি খরচে হজ করা বললেও অত্যুক্তি হবে না। হজ করাই যদি তাঁদের উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, তাহলে নিজেদের অর্থেই সেটা করা উচিত। মনে রাখতে হবে, সরকারি প্রতিনিধিদলের প্রত্যেকের পেছনে মোটা অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা খরচ হবে; যা গুনতে হবে দেশের সাধারণ মানুষকে।
কেবল হজের নামেই নয়, বিদেশে কেনাকাটা করতেও সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা সরকারি খরচে বিদেশভ্রমণের সুযোগ হাতছাড়া করেন না।
বৃহস্পতিবার প্রথম আলোয় ‘লিফট কিনতে তুরস্ক যাচ্ছেন সহ-উপাচার্যসহ ছয়জন’ শিরোনামে একটি খবর প্রকাশিত হয়েছে। এই খবরের মর্মার্থ হলো ‘পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য এস এম মোস্তফা কামাল খানসহ ছয় সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল তুরস্কে যাচ্ছে লিফট কিনতে। গত ৯ মে এই সফরের নির্ধারিত দিন থাকলেও তাঁরা ভ্রমণ পিছিয়ে ৬ জুন তুরস্কের উদ্দেশে যাত্রা করবেন। সেখানে তাঁরা ১০ দিন থাকবেন। সফরের বিষয়টি সম্প্রতি চিঠি দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারকে জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকল্প পরিচালক, যিনি নিজেও এই ভ্রমণকারীদের একজন।’
এর আগেও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যেকোনো অজুহাতে বিদেশভ্রমণের বহু খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এসব নিয়ে বিভিন্ন মহলে সমালোচনা হলেও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা তাতে কর্ণপাত করেননি। বিদেশভ্রমণের পক্ষে পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য যে যুক্তি দেখিয়েছেন, সেটি খুবই হাস্যকর। তিনি বলেছেন, ‘মানুষ এখন একটি শার্ট কিনতে গেলেও বোতামটি উল্টিয়ে দেখেন। প্রকল্পটি চার বছর আগের। এর সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্টতা নেই, আবার সরকারের সংশ্লিষ্টতাও নেই।’
সহ-উপাচার্য মহোদয় নিজের টাকায় যেখানে খুশি যেতে পারেন। কেউ আপত্তি করবেন না। আর তাঁদের বিদেশভ্রমণের টাকাটা যদি সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষই না দেয়, কে দেবে? ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। কিন্তু তারা নিশ্চয়ই নিজেদের পকেট থেকে সেই টাকা দেবে না। শেষ পর্যন্ত এটি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকেই আদায় করে নেবে।
এ মুহূর্তে দেশে ডলার-সংকট চরমে। কয়লাসহ অনেক নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি আটকে আছে ডলার-সংকটের কারণে। এ অবস্থায় দুর্লভ বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে হজ সহায়তা কিংবা লিফটের মান দেখার জন্য কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর অবশ্যই রহিত হওয়া প্রয়োজন। যেকোনো অজুহাতে পদাধিকারীদের বিলাসী বিদেশভ্রমণ বন্ধ হোক।