গায়েবি মামলার ফিরে আসা

নির্বাচনী পরিবেশের জন্য শুভ লক্ষণ নয়

রাজনৈতিক কর্মসূচি ঘিরে সহিংসতা হলে নেতা-কর্মীদের নামে গণহারে মামলা দিয়ে হয়রানির ‘ঐতিহ্য’ অনেক পুরোনো। বিরোধী দলে যাঁরা থাকেন, তাঁরা প্রধানভাবে এর ভুক্তভোগী। কাজেই তাঁরা এ নিয়ে সোচ্চার থাকেন। কিন্তু ক্ষমতায় গিয়ে তাঁরাই আবার এটিকে বিরোধীদের শায়েস্তার অস্ত্র করে তুলতে কোনো রকম কার্পণ্য করেন না।

রাজনৈতিক মামলার মাধ্যমে বিরোধীদের চাপে ফেলার এই কৌশল সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নতুন মাত্রা পেয়েছে। ঘটনা ঘটেইনি, অথচ মামলা দেওয়া হয়। এ ধরনের মামলা তাই ‘গায়েবি মামলা’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। 

২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনপিসহ বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের নামে ব্যাপক হারে এ ধরনের গায়েবি মামলা দেওয়া হয়েছিল। অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করায়, তাতে শুধু রাজনৈতিক নেতা-কর্মী নন, সাধারণ মানুষকেও হয়রানির মুখে পড়তে হয়েছিল। প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, গায়েবি মামলা আবার ফিরে এসেছে। তবে আগেরবার যেমন পুলিশ বাদী হয়ে অধিকাংশ মামলা করেছিল, এবারে মামলার বাদী সরকারদলীয় নেতা-কর্মীরা। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে গায়েবি মামলার প্রত্যাবর্তন সুস্থ ধারার রাজনীতির জন্য মোটেই শুভ লক্ষণ নয়।

মামলা গায়েবি হলেও আসামি যাঁদের করা হয়, তাঁরা বাস্তবের রক্তমাংসের মানুষ এবং তাঁদের হয়রানি ও ভোগান্তিটাও বাস্তব। প্রায় সব ক্ষেত্রেই মামলার বিবরণ ও ধারা একই। গত বছরের নভেম্বর থেকে এ বছরের মে মাস পর্যন্ত সাত মাসে এ ধরনের গায়েবি মামলা হয়েছে ৫০টি। এর মধ্যে ৪০টি মামলার বাদী আওয়ামী লীগ নেতারা এবং ১০টি মামলার বাদী পুলিশ নিজে। এসব মামলার আসামি বিএনপির ১ হাজার ৭০১ জন নেতা-কর্মী, অজ্ঞাতনামা আসামি আরও ২ হাজার ৫৭৫ জন। হামলা, ককটেল নিক্ষেপ ও অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকাণ্ডের অভিযোগ তোলা হয়েছে এসব মামলায়।

প্রথম আলোর প্রতিবেদক হামলা ও ককটেল বিস্ফোরণের অভিযোগে মামলা করা হয়েছে, এমন ১৭টি ঘটনাস্থল সরেজমিনে অনুসন্ধান করেছেন। দেখা যাচ্ছে যে মামলার বিবরণের সঙ্গে স্থানীয় বাসিন্দাদের বক্তব্যে মিল খুঁজে পাওয়া যায়নি। ১৫টি স্থানের লোকজন জানিয়েছেন, মামলার উল্লিখিত তারিখে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের ওপর হামলার কোনো ঘটনা ঘটেনি। যে ঘটনার অস্তিত্ব বাস্তবে পাওয়া যাচ্ছে না, সেখানে কীভাবে মামলা হতে পারে?

শুধু ঢাকা নয়, সবখানে রাজনৈতিক মামলা ও গায়েবি মামলার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে বিএনপির কর্মসূচির আগে মামলা ও ধরপাকড়ের নিয়মিত খবর পাওয়া যাচ্ছে। বিএনপির নেতাদের অভিযোগ, গতবারের মতো এবারের নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপির নেতা-কর্মীদের ঘরছাড়া করতে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা গায়েবি মামলা দিচ্ছেন। পক্ষান্তরে আওয়ামী লীগের নেতাদের ভাষ্য হলো, হামলার ঘটনা ঘটছে বলেই মামলা হচ্ছে। গায়েবি মামলা বলে কিছুর অস্তিত্ব নেই।

অস্তিত্বহীন ঘটনায় মামলা ও হয়রানি শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক বিদ্বেষ ও অসহিষ্ণুতাকেই উসকে দিতে পারে। পরপর দুটি জাতীয় নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ায় পর এবারে নানা মহল থেকে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের আকাঙ্ক্ষা, তাগিদ ও চাপ তৈরি হয়েছে। সরকারের তরফে বারবার অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করা হচ্ছে। এ প্রেক্ষাপটে গায়েবি মামলা নিশ্চিতভাবেই সুষ্ঠু নির্বাচনী পরিবেশকে বিনষ্ট করবে।

কেউ যদি রাজনৈতিক কর্মসূচিতে সহিংসতা করে, তবে তার বিরুদ্ধে পুলিশের ব্যবস্থা নেওয়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু যেখানে ঘটনাই ঘটেনি, সেখানে গায়েবি মামলা দিয়ে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করার কৌশল থেকে অবশ্যই বেরিয়ে আসতে হবে।