সমন্বয় কমিটি বাতিলের যৌক্তিকতা কী

১৩ দিনের মাথায় পাঠ্যপুস্তক সংশোধন ও পরিমার্জনের কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার লক্ষ্যে গঠিত সমন্বয় কমিটি বাতিল করার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। মহলবিশেষের আপত্তিতে যদি সরকার এই সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে, তাহলে সেটি অত্যন্ত খারাপ দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচিত হবে। সরকারের সক্ষমতাও সে ক্ষেত্রে প্রশ্নের মুখে পড়বে। এই সরকারকে অনেক বড় বড় রাষ্ট্রীয় সংস্কারের কাজ করতে হবে এবং জনগণ সেটাই প্রত্যাশা করে। এখন পাঠ্যক্রম সংশোধন ও পরিমার্জন কাজ দেখাশোনার জন্য একটি কমিটি গঠন করে যদি তা টিকিয়ে রাখা না যায়, তবে তা জনগণের মধ্যে হতাশা তৈরি করবে। 

এ বিষয়ে শিক্ষা ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তাকে গ্রহণ করা কঠিন। তিনি বলেছেন, এটা অনানুষ্ঠানিক কমিটি, ভুলবশত প্রজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে। সমন্বয় কমিটি নিয়ে কেন এই লুকোছাপা? উল্লেখ্য, ১৫ সেপ্টেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয় জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) প্রণীত ও মুদ্রিত সব পাঠ্যপুস্তক সংশোধন-পরিমার্জন কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন ও সমন্বয়ের লক্ষ্যে ১০ সদস্যের একটি সমন্বয় কমিটি গঠন করে। 

এর আগে পাঠ্যপুস্তক সংশোধন ও পরিমার্জন কমিটিতে কমপক্ষে দুজন আলেমকে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি তোলে জামায়াতে ইসলামী ও হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশসহ ধর্মভিত্তিক কয়েকটি দল ও সংগঠন। এই দাবি তারা করতেই পারে। কমিটির বিষয়ে কারও ভিন্নমত থাকলে সেটাও যে কেউ জানাতে পারেন। কিন্তু দেখা গেল একটি গোষ্ঠী কমিটির দুজন সদস্যকে ইসলামবিদ্বেষী ট্যাগ দিয়ে প্রচারণা শুরু করে। কাউকে এভাবে চিহ্নিত করা বা ট্যাগ দেওয়া কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। পতিত স্বৈরাচারী সরকার এই কৌশল অবলম্বন করত। এটা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বা ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের চেতনার পরিপন্থী। 

কোনো ইস্যুর সঙ্গে যখন ধর্মের প্রশ্ন যুক্ত হয়, তখন বিষয়টি অনেক ক্ষেত্রে সংবেদনশীল হয়ে ওঠে। ফলে তাৎক্ষণিকভাবে সেটির সমাধান খুঁজতে যাওয়া কাম্য নয়। এর জন্য সংশ্লিষ্ট সব পক্ষ নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা করাটা গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষা উপদেষ্টা বলেছেন, সমন্বয় কমিটি বাতিল হলেও পাঠ্যবই পরিমার্জনের কাজ চলবে। তিনি যুক্তি দেখিয়েছেন, নতুন শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যবই ছাপাখানায় দিতে হাতে সময় খুব কম। এখন বড় পরিবর্তনের সুযোগ নেই। 

অতীতে বিভিন্ন সময়ে দেখা গেছে ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর চাপে সরকার পাঠ্যপুস্তকে নানা পরিবর্তন এনেছে এবং সংশোধনের জন্য বিভিন্ন কমিটি গঠন করেছে। আর এবার অন্তর্বর্তী সরকার মহলবিশেষের আপত্তির মুখে খোদ কমিটিই বাতিল করে দিল। 

এ বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ যে মন্তব্য করেছেন, তা তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করি। তিনি বলেছেন, বাইরের নানা কথাবার্তা বা মিথ্যাচার ও হিংসামিশ্রিত প্রচারণার পর কমিটি বাতিলের মাধ্যমে সরকার নিজের দুর্বলতাই প্রকাশ করল। গণতান্ত্রিক রূপান্তর ও শিক্ষা সংস্কারের পথে এটি খুবই খারাপ দৃষ্টান্ত হবে। 

অন্তর্বর্তী সরকার পাঠ্যবই পরিমার্জন করতে গিয়ে নতুন বিতর্কের জন্ম দিল। কমিটি বাতিলের প্রতিবাদে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে শাহবাগ ও কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে কর্মসূচি পালিত হয়েছে। যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ফসল হিসেবে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হলো, সেই আন্দোলনে সাহসী ভূমিকা পালনকারী দুই শিক্ষকের প্রতি এই আচরণ অগ্রহণযোগ্য। 

মহলবিশেষের দাবি বা আবদারের মুখে শিক্ষা মন্ত্রণালয় যেভাবে সমন্বয় কমিটি বাতিল করল, তাতে সরকার নিজের দুর্বলতাকেই তুলে ধরল। সরকার কাকে নিয়ে কোন কমিটি করবে, এটা সম্পূর্ণ তাদের এখতিয়ার। অবশ্যই আমাদের সবার চাওয়া থাকবে যোগ্য, উপযুক্ত ও সক্ষম ব্যক্তিরাই সেখানে থাকবেন। সেটি নিশ্চিত করার জন্যও আমরা সরকারকে আহ্বান জানাব। কমিটি গঠন নিয়ে যৌক্তিক সমালোচনা অবশ্যই গ্রহণযোগ্য। কিন্তু কমিটি গঠন বা বাতিলের নামে শিক্ষকদের অপদস্থ করা বা তাঁদেরকে বিশেষ ট্যাগ দেওয়া পুরোপুরি অগ্রহণযোগ্য।