সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়

ঝুঁকিতে মা ও শিশুর প্রাণ

কুড়িগ্রামে অপচিকিৎসা বন্ধ হোক

বাংলাদেশ প্রসূতি ও শিশুসন্তানদের চিকিৎসার হাল কতটা করুণ ও ভয়াবহ, তা জানা গেল প্রথম আলোর কুড়িগ্রাম প্রতিনিধির সরেজমিন প্রতিবেদনে। চরের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সন্তান প্রসবের সময় সমস্যা দেখা দিলে চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই। কাছাকাছি কোনো স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্র নেই। বাধ্য হয়ে এসব মা হাতুড়ে ডাক্তার ও অপ্রশিক্ষিত ধাইয়ের শরণাপন্ন হন। এ কারণে কখনো সন্তান, কখনো মাকে জীবন দিতে হয়।

প্রথম আলোর খবর থেকে জানা যায়, কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার মশালের চরের গৃহবধূ জরিনা বেগম পল্লিচিকিৎসকের পরামর্শে ‘অক্সিটোসিন’ ইনজেকশন দেওয়ার ১০ মিনিট পর মৃত সন্তান প্রসব করেন। সাহেবের আলগা ইউনিয়নের গাঙচিলা গ্রামের সাজেদা বেগমকে দূরের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নেওয়ার সময় পথেই মারা যান তিনি। জরিনার সন্তান হারানো, সাজেদার মৃত্যুর নেপথ্যে অপচিকিৎসাই দায়ী।

প্রসবের জন্য জরায়ুর প্রসারণ ঘটাতে, প্রসবের গতি বাড়াতে এবং প্রসবের পর রক্তপাত বন্ধ করতে ‘অক্সিটোসিন’ ইনজেকশন ব্যবহৃত হয়। এটি পেশিতে বা শিরায় দেওয়া হয়। কুড়িগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের প্রসূতিবিশেষজ্ঞ নাসিমা খাতুন বলেছেন, পল্লিচিকিৎসকদের অসচেতনতা ও অপচিকিৎসায় প্রসূতি মা ও নবজাতকের জীবন গুরুতর ঝুঁকিতে পড়ছে।

 শারীরিক অবস্থা পরীক্ষার পর প্রসূতিকে এই ইনজেকশন দিতে হয়। কিন্তু পল্লিচিকিৎসকেরা পরীক্ষা ছাড়াই ব্যথা উঠলে অক্সিটোসিন ইনজেকশন দিয়ে দেন।

জেলায় পল্লিচিকিৎসকদের অক্সিটোসিন ইনজেকশনের ব্যবহার নিয়ে সরকারি স্বাস্থ্যসেবার দুই বিভাগ—জেলা সিভিল সার্জন ও পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ে কোনো তথ্য নেই। এটা কী ধরনের কথা?

দৈবচয়নের ভিত্তিতে নাগেশ্বরীর নুনখাওয়া, উলিপুরের বেগমগঞ্জ ও সাহেবের আলগা এবং সদর উপজেলার যাত্রাপুর ও ঘোগাদহ ইউনিয়নের ১২টি দ্বীপচরের ৬০০ নারীর ওপর চালানো জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে, ৬০০ জনের মধ্যে ৯৯ প্রসূতিকে ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই অক্সিটোসিন ইনজেকশন দিয়েছেন পল্লিচিকিৎসকেরা। এ কারণে প্রসবের সময় ৫৯টি নবজাতক ও ৬ জন প্রসূতির মৃত্যু হয়েছে। উল্লেখ্য, সনদপ্রাপ্ত চিকিৎসকদের নির্দেশনা ছাড়া এই ইনজেকশন দেওয়া নিষিদ্ধ।

কেবল কুড়িগ্রামে যদি ৬০০ জনের মধ্যে ৫৯টি ও ৬ জন প্রসূতি মারা গিয়ে থাকেন, সারা দেশের চিত্রটা অনুমান করা কঠিন নয়। এই যে অপচিকিৎসার কারণে মা ও সন্তানেরা মারা যাচ্ছে, তার প্রতিকার কী। জেলা সিভিল সার্জন বা পরিবার পরিকল্পনা অফিস কী করছে?

 স্বাস্থ্য বিভাগের কর্তাব্যক্তিরা চিকিৎসাসেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার দাবি করেন। কিন্তু তঁারা সমস্যাগুলো সমাধানে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেন না। এ ক্ষেত্রে প্রথমে যেই কাজটি করা প্রয়োজন, তা হলো সন্তান ধারণ করার পর মায়েদের নিয়মিত স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া, যাতে কোনো সমস্যা দেখা না দেয়। আর জটিলতা হলে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে প্রশিক্ষিত কর্মী নিয়োগ ও সরঞ্জাম সরবরাহ করতে হবে। স্থানীয়ভাবে এ ব্যাপারে সচেতনতা বৃদ্ধি করা জরুরি। এ ক্ষেত্রে জেলা সিভিল সার্জন ও পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয় ইউনিয়ন পরিষদের জনপ্রতিনিধিদের কাজে লাগাতে পারে।

প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ গরিব ও অসচেতন। এ কারণে কে সনদপ্রাপ্ত চিকিৎসক ও আর কার সনদ নেই, সেটা তাঁরা না জেনেই পল্লিচিকিৎসকদের কাছে গিয়ে প্রতারিত হন। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল আইনের ধারা ২৮(৩) অনুযায়ী, কেউ স্বঘোষিত চিকিৎসক বা ডেন্টাল চিকিৎসক বলে দাবি করলে বা পাস না করে নামের আগে চিকিৎসক পদবি লাগালে শাস্তির বিধান আছে। কিন্তু সেই শাস্তি কার্যকর করার কোনো উদ্যোগ নেই। 

মানুষ নিরুপায় হয়েই হাতুড়ে চিকিৎসকদের কাছে যান। হাতের কাছে প্রশিক্ষিত চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্র থাকলে তঁাদের এভাবে প্রতারিত হতে হতো না। অপচিকিৎসা থেকে প্রসূতি ও সন্তানদের রক্ষার জন্য স্বাস্থ্য উপদেষ্টার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।