সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়

মুঠোফোনে নজরদারি

নাগরিক মানেই সরকারের কাছে সন্দেহভাজন

গত বুধবার প্রথম আলোয় ‘ভোটের আগে নজরদারির ব্যবস্থা’ শিরোনামে যে খবরটি প্রকাশিত হয়েছে, তা মুঠোফোন ব্যবহারকারী প্রত্যেক নাগরিকের জন্য আতঙ্কের। সংবিধানের সপ্তম ধারায় বলা আছে, ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হইবে।’ অথচ এই ব্যবস্থায় প্রত্যেক নাগরিককেই সন্দেহভাজনের তালিকায় রাখা হয়েছে। 

প্রথম আলোর খবর থেকে জানা যায়, নির্বাচনের আগে মুঠোফোনে নজরদারির নতুন ব্যবস্থা চালু করতে যাচ্ছে সরকার। এ ব্যবস্থায় কোন মুঠোফোন ব্যবহারকারী কোথায় অবস্থান করছেন, তার সুনির্দিষ্ট তথ্য পাবে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থা। এটি স্থাপন করতে মোবাইল অপারেটরদের ব্যয় হবে প্রায় ২০০ কোটি টাকা। 

বর্তমানে মুঠোফোন ব্যবহারকারীদের ওপর নজরদারির যে ব্যবস্থা আছে, তাতে ব্যবহারকারী কোন এলাকায় রয়েছেন, তা জানা যায়। তবে সুনির্দিষ্ট অবস্থান জানা যায় না। নতুন ব্যবস্থা হবে সুনির্দিষ্ট। অর্থাৎ ব্যক্তি কোন ভবনে রয়েছেন, তা শনাক্ত করা সম্ভব হবে। পাশাপাশি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) ব্যবহার করে জানা যাবে বিপুলসংখ্যক মানুষের গতিবিধি। বর্তমান ব্যবস্থায় বেশিসংখ্যক মানুষের তথ্য সংগ্রহ করা কঠিন। প্রত্যেকের তথ্য আলাদাভাবে সংগ্রহ করতে হয়। নতুন ব্যবস্থা কাজ করবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে। এতে হাজার হাজার মানুষের জিও লোকেশন বিশ্লেষণ করা সহজ হয়ে যাবে। 

নজরদারির নতুন ব্যবস্থাটির নাম ‘ইন্টিগ্রেটেড ল-ফুল ইন্টারসেপশন সিস্টেম’ (আইএলআইএস বা সমন্বিত আইনসম্মত আড়ি পাতার ব্যবস্থা)। ২০২২ সালের ১৭ মার্চ ফ্রান্সের সংবাদমাধ্যম ইন্টেলিজেন্স অনলাইন এক প্রতিবেদনে জানায়, বাংলাদেশ ইন্টারনেটভিত্তিক যোগাযোগমাধ্যম টেলিগ্রামে আড়ি পাতার প্রযুক্তি কিনেছে। 

আগামী জানুয়ারি মাসের শুরুর দিকে দেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। তার আগে নজরদারির এ নতুন ব্যবস্থা চালু করার উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই। তাহলে কি সরকার নাগরিকের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা হরণ করতে যাচ্ছে? এটি কেবল সংবিধানবিরোধী নয়, মানবাধিকারেরও পরিপন্থী। 

আরও বিস্ময়কর হলো, নতুন নজরদারি ব্যবস্থার খরচ জোগাতে হবে টেলিফোন অপারেটরদেরই। তারা নিশ্চয়ই গাঁটের পয়সা দিয়ে সেটা করবে না। মুঠোফোন গ্রাহকদের কাছ থেকেই সেটা আদায় করবে। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ আইনের ৯৭(ক) ধারায় বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বা জনশৃঙ্খলার স্বার্থে’ যেকোনো টেলিযোগাযোগ সেবা ব্যবহারকারীর পাঠানো বার্তা ও কথোপকথন প্রতিহত, রেকর্ড ধারণ বা তত্–সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহের জন্য সরকার সরকারি সংস্থার কোনো কর্মকর্তাকে ক্ষমতা দিতে পারবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘সভ্য গণতান্ত্রিক দেশগুলোয় নির্দিষ্ট ব্যক্তির ওপর আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে নজরদারির সুযোগ রাখা হয়, গণভাবে নয়।’ 

মনে রাখতে হবে, রাষ্ট্র ও সরকার এক নয়। রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য সরকার যে পদক্ষেপই নিক না কেন, সব নাগরিকই সমর্থন করবে। কিন্তু কোনো সরকার যদি তার সমালোচনাকে রাষ্ট্রের জন্য বিপজ্জনক বলে মনে করে নাগরিকদের প্রতি নজরদারি করে, সেটা মেনে নেবে না। রাষ্ট্রের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে নজরদারির প্রয়োজন হলে, সেটাও আসতে হবে আদালতের মাধ্যমে। সাবেক ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কিংবা বর্তমান সাইবার নিরাপত্তা আইন নিয়ে আমাদের প্রধান আপত্তিও এটি। একজন নাগরিক দেশপ্রেমিক কিংবা দেশদ্রোহী, সেই সনদ কোনো পুলিশ কর্মকর্তা দিতে পারেন না। 

আড়ি পাতার নতুন ব্যবস্থা নাগরিকের ব্যক্তিস্বাধীনতা ও গোপনীয়তা—দুটিই হরণ করবে। অতএব সরকার নজরদারির নামে আড়ি পাতার নতুন প্রকল্প থেকে সরে আসবে আশা করি।