অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ঋণখেলাপিদের নির্লজ্জ বলে আখ্যায়িত করেছেন। তাঁর এই মন্তব্যে নির্লজ্জ ঋণখেলাপিরা আদৌ লজ্জিত হবেন
বলে মনে হয় না। এর আগে জাতীয় সংসদেও ১০০ শীর্ষ ঋণখেলাপির তালিকা প্রকাশ করেছিলেন তিনি। সেই তালিকায় ক্ষমতাসীন দলের দুজন সাংসদের নামও ছিল। যাঁদের দায়িত্ব আইন করে ঋণখেলাপিদের ধরা, তাঁরা নিজেরাই যদি শীর্ষ ঋণখেলাপি হন, তাহলে ঋণখেলাপির অপসংস্কৃতির প্রসার ঘটাই স্বাভাবিক।
অর্থমন্ত্রীর দেওয়া তালিকা থেকে জানা যায়, দেশে বর্তমানে ঋণখেলাপি ২ লাখ ৩০ হাজার ৬৫৮ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। এসব ঋণখেলাপির কাছে ৮৮টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অনাদায়ি অর্থের পরিমাণ ১ লাখ ৩১ হাজার ৬৬৬ কোটি ১৬ লাখ টাকা। ঋণ অনাদায়ি ব্যাংকের তালিকার শীর্ষেও রয়েছে সরকারি চারটি ব্যাংক। ঋণের পরিমাণ যথাক্রমে সোনালী ব্যাংকের ১৮ হাজার ৬৬২ কোটি ৯৭ লাখ ৩০ হাজার টাকা, জনতা ব্যাংকের ১৪ হাজার ৮৪০ কোটি ২৭ লাখ টাকা, অগ্রণী ব্যাংকের ৯ হাজার ২৮৪ কোটি ৪২ লাখ টাকা এবং বেসিক ব্যাংকের ৮ হাজার ৫৭৬ কোটি ৮৫ লাখ ৭ হাজার টাকা।
আবুল মাল আবদুল মুহিত একজন অভিজ্ঞ আমলা। তিন মেয়াদে (আওয়ামী লীগের দুই মেয়াদে প্রায় ১০ বছর এবং সামরিক শাসক এরশাদের আমলে ২ বছর) অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। এর আগে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে সচিব ছাড়াও বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকে গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন ছিলেন। তিনি যে ১ লাখ ৩১ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণের হিসাব দিয়েছেন, এর বেশির ভাগই তাঁর আমলের। তাঁর সময়েই হল–মার্ক, বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির মতো ঘটনা ঘটেছে।
অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ১০ শতাংশ খেলাপি বা মন্দ ঋণ থাকতে পারে। কিন্তু বর্তমানে মন্দ ঋণের পরিমাণ অনেক বেশি এবং ব্যাংকগুলো থেকে নানা কারসাজি করে কথিত ব্যবসায়ীরা ঋণ নিয়ে আর শোধ করছেন না। এর পেছনে যে রাজনৈতিক প্রভাব-প্রতিপত্তির বিষয় আছে, সেটি এখন দিবালোকের
মতো সত্য।
গত ১০ বছরে ব্যাংকিং খাতে যে চরম বিশৃঙ্খল অবস্থা বিরাজ করছে তাতে শুধু সরকারি নয়, বেসরকারি খাতের অনেক ব্যাংকও ঝুঁকিতে রয়েছে। কিন্তু অর্থমন্ত্রী মাঝেমধ্যে উষ্মা প্রকাশ ছাড়া ব্যাংকিং খাতের বিশৃঙ্খলা ও দুর্নীতি বন্ধ করতে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিয়েছেন, সে রকম উদাহরণ কমই আছে। মধ্যরাতে কোনো কোনো ব্যাংকের মালিকানা পরিবর্তনের ঘটনাও ঘটেছে। অনেক সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংককেও অসহায়ত্ব প্রকাশ করতে দেখেছি।
অর্থমন্ত্রীকে যেই কথিত ঋণগ্রহীতা ঋণ নিতে কয়েক জোড়া জুতা খোয়ানোর কাহিনি শুনিয়েছেন, তাঁকে খুঁজে বের করা দরকার। ঋণ নিতে তাঁর জুতা খোয়ানোর পেছনের রহস্যটি বের করতে পারলে ব্যাংকিং খাতের অনেক অনিয়ম-দুর্নীতিরই অবসান ঘটবে। কেউ যদি ‘জুতা খুইয়ে’ ঋণ নিয়েও থাকেন, তার অর্থ এই নয় যে তিনি সেটি শোধ করবেন না।
জনগণের অর্থ নিয়ে যাঁরা এ ধরনের মামাবাড়ির আবদার তোলেন, অর্থমন্ত্রী তাঁদের ছেড়ে দিতে পারেন না। খেলাপি ঋণগ্রহীতাদের পাশাপাশি যেসব ব্যাংক কর্মকর্তা নিয়মবহির্ভূতভাবে ঋণ দিয়েছেন, তাঁদেরও আইনের আওতায় আনা আবশ্যক হয়ে পড়েছে।
অর্থমন্ত্রী তাঁর উত্তরসূরির জন্য প্রতিবেদন লিখে যাওয়ার কথা বলেছেন। কিন্তু প্রতিবেদন লেখা বা সদুপদেশ দেওয়ার চেয়ে জরুরি হলো তাঁর ভাষায় নির্লজ্জ ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া। অন্যথায় নির্লজ্জ ঋণখেলাপিদের ছাড় দেওয়ার দায় তিনি এড়াতে পারবেন না।