সড়কে অব্যবস্থাপনা ও নৈরাজ্য এবং তদারকি সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গাফিলতিতে দুর্ঘটনা ও হতাহতের মিছিল বাড়ছেই। গত রোববার ঢাকার সাভারের বলিয়ারপুরে যে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় পরমাণু শক্তি কমিশনের তিনজন বিজ্ঞানী, একজন প্রকৌশলী ও দুটি বাসের চালক নিহত হয়েছেন, সেটি কোনো বিবেচনায়ই গ্রহণযোগ্য নয়। একটি দুর্ঘটনার পেছনে যত ধরনের অবহেলা এবং আইনের ব্যত্যয় থাকতে পারে, তার দৃষ্টান্ত এটি।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের বরাতে প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, সেইফ লাইন নামের যে বাসের কারণে দুর্ঘটনাটি ঘটেছে, আট বছর ধরে সেটির সড়কে চলাচলের অনুমতি বা রুট পারমিট ছিল না। ট্যাক্সের মেয়াদ শেষ হয়েছে সাত বছর আগে। বাসের সহকারীর ভাষ্যে জানা যাচ্ছে, আগের দিন সকালে গাবতলী থেকে ছেড়ে আবার রাতে ঝিনাইদহের শৈলকুপা হয়ে পরদিন ঢাকায় ফিরছিল।
দুর্ঘটনার অনেক আগে থেকেই চালক ক্লান্ত ছিলেন, ঢুলুঢুলু চোখে গাড়ি চালাচ্ছিলেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া দুর্ঘটনার ভিডিওতেও অস্বাভাবিকতা দেখা যাচ্ছে। বাসটি চলন্ত অবস্থায় উল্টো লেনের একটি ট্রাককে ধাক্কা দিয়ে সড়ক বিভাজক পেরিয়ে বিপরীত লেনে থাকা পরমাণু শক্তি কমিশনের বাসটিকে সজোর ধাক্কা দেয়।
এ দুর্ঘটনার পর পুলিশ যে পদক্ষেপ নিয়েছে, সেটাও অদক্ষতা ও গাফিলতির বড় দৃষ্টান্ত। সেইফ লাইন পরিবহনের বাসের চালকের যে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যু হয়েছে, সেটি সাভার হাইওয়ে থানার পুলিশ জানতে পারে ৩০ ঘণ্টা পর। এ দুর্ঘটনায় যে মামলা হয়েছে, তাতে শুধু চালককে আসামি করা হয়েছে। বাসের মালিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ায় প্রশ্ন উঠেছে।
যে তিন বিজ্ঞানী নিহত হয়েছেন, তার একজন পূজা সরকার। ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন তিনি। কিন্তু একটা দুর্ঘটনা নিমেষেই সব স্বপ্নকে নস্যাৎ করে দিয়েছে। নিহত আরেক বিজ্ঞানী মো. আরিফুজ্জামানের মা প্রশ্ন করেছেন, ‘বাজান আমার জাপানে ছিল, ভালোই ছিল। কেন দেশে আনলাম আমি!’
বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীর অকালে এভাবে প্রাণ হারানো শুধু পরিবারের জন্য নয়, দেশের জন্যও অপূরণীয় ক্ষতি। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান নিহত ব্যক্তিদের জন্য শোক প্রকাশ করতে গিয়ে যথার্থই বলেছেন, ‘কত মানুষের করের টাকা, কষ্টের টাকায় একেকজন বিজ্ঞানী তৈরি হন। তাঁদের কোনো পরিপূরক আমাদের কাছে নেই। সাভারে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের প্রতি আমরা শোক জানাই।’
২০১৮ সালের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের পর সড়কে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে গঠিত কমিটি ৩০টি নির্দেশনা জারি করেছিল। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দূরপাল্লার পথে বিকল্প চালক রাখা এবং একজন চালককে টানা পাঁচ ঘণ্টার বেশি বাস না চালানোর নির্দেশনা দিয়েছিলেন।
সাভারের দুর্ঘটনায় আমরা দেখতে পেলাম, প্রধানমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সেই নির্দেশনা বাস্তবায়িত হয়নি। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ, পরিবহননেতা, বাসমালিক, চালক, হাইওয়ে পুলিশ কিংবা সংশ্লিষ্ট কেউ সড়কে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় তেমন উদ্যোগী হননি।
সাভারের দুর্ঘটনাকে নিছক সড়ক দুর্ঘটনা বলতে আমরা রাজি নই। অবহেলাজনিত দুর্ঘটনা কিংবা কাঠামোগত হত্যাকাণ্ডের উদাহরণ এটি। বিশেষজ্ঞদের মতে ফিটনেস ও রুট পারমিট না থাকা বাস ‘প্রাণঘাতী অস্ত্রের মতো বিপজ্জনক’। এ ধরনের একটি বাস আট বছর ধরে কীভাবে সড়কে চলাচল করল?
বাসমালিক কীভাবে নিশ্চিন্তে সেটি সড়কে ছেড়ে দিয়েছেন? হাইওয়ে পুলিশ কি এতগুলো বছর ইংরেজি সাহিত্যের চরিত্র ‘রিপ ভ্যান উইঙ্কল’-এর মতো ঘুমিয়ে ছিল? আমরা মনে করি, বাসটি কীভাবে সড়কে চলাচল করেছে, তার যথাযথ তদন্ত হতে হবে। সাভারের দুর্ঘটনায় কোনোভাবেই হাইওয়ে পুলিশ দায় এড়াতে পারে না।