এত দিন আমরা ধনী ব্যবসায়ী শিল্পপতিদের কথা শুনে এসেছি। এবার শাহেদ নামর এক ধনী চোরের সন্ধান পাওয়া গেছে; যাঁর নেতৃত্বে গত ২১ বছরে ৫ হাজার ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান থেকে পণ্য চুরির ঘটনা ঘটেছে। এই ধনী চোর দুটি বাড়ি ও একটি ইটভাটা ছাড়াও ২৯টি লরিরও মালিক। শাহেদের ঘটনায় ফের প্রমাণিত হলো মানুষ গরিব বলে চুরি করে না; ধনী হওয়ার জন্য চুরির ঘটনা বাংলাদেশে মহামারিতে রূপ নিয়েছে।
আগে মহাসড়কে গাড়ির তেল ও যন্ত্রপাতি চুরির অভিযোগ বেশি ছিল। কিন্তু এতে ঝুঁকি বেশি, লাভ কম। এ কারণে মহাসড়কের চোরেরা রপ্তানি করা তৈরি পোশাকের প্রতি ঝুঁকে পড়েছেন। শাহেদ ও তাঁর সহযোগীরা চুরি-ছিনতাই-ডাকাতিতে অবিশ্বাস্য কৃতিত্ব দেখালেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তথা হাইওয়ে পুলিশ একেবারে নির্বিকার। শাহেদ সর্বশেষ গত ১৭ সেপ্টেম্বর গোয়েন্দা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়ে এখন কারাগারে। তাঁর বিরুদ্ধে ২৪টি মামলা আছে। গত বছরও তিনি গ্রেপ্তার হয়ে আট মাস জেল খেটে বাইরে এসে ‘পুরোনো পেশায়’ ফিরে যান।
কেবল শাহেদ বাহিনী নয়, মহাসড়কে এ রকম আরও অনেক চোর চক্র সক্রিয় আছে। এদের সঙ্গে কাভার্ড ভ্যানের একশ্রেণির চালকের যোগসাজশ আছে। গোয়েন্দাদের ভাষ্য অনুযায়ী, কারখানায় লোডিং সম্পন্ন হওয়ার পর অপরাধের অংশীদার লরিচালকেরা চালান, রুট ও সময় সম্পর্কে অন্যদের বার্তা দেন। পরিকল্পনা অনুসারে পণ্যবাহী যান মহাসড়কের নির্দিষ্ট জায়গায় থামে। সেখান থেকে তা গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ, কুমিল্লার চান্দিনা, ফেনী, মিরসরাই ও চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের গোপন গুদামে নেওয়া হয়। সেখানে চক্রগুলো পণ্যবাহী যানের দরজায় লাগানো তালার সিল খুলে ভরা কার্টনের নিচ থেকে কিছু পোশাক বের করে নেয়। পরে খালি অংশ বালু, ন্যাকড়া এমনকি কাদা দিয়ে পূর্ণ করে আবার সিল করে দেওয়া হয়।
বিজিএমইএর তথ্য অনুসারে, মহাসড়কে চুরির ঘটনা বাড়ছে। ২০১৯ সালে এ ধরনের দুটি ঘটনা ঘটেছিল। ২০২০ সালে এমন নয়টি ঘটনা ঘটে। আর চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত এমন ২২টি ঘটনা ঘটেছে। ফলে তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের উদ্বেগও বাড়ছে।
তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর নেতারা গত জুলাই মাসে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে চুরি বন্ধের জন্য হাইওয়ে পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শককে প্রধান করে বিজিএমইএ, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসমূহ এবং বাংলাদেশ কাভার্ড ভ্যান মালিক সমিতির প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে কমিটি গঠন করা হয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চুরি ঠেকাতে চার মাসের মধ্যে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে সিসিটিভি বসানো হবে বলে আশ্বাস দেন।
তবে সিসিটিভি বসালেই মহাসড়কে পণ্য চুরি বন্ধ হবে না; যদি না চোর চক্র ও তাদের সহযোগীদের শাস্তি নিশ্চিত করা যায়। বাংলাদেশ ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান, ট্রান্সপোর্ট এজেন্সি মালিক সমিতি সব ট্রান্সপোর্ট এজেন্সির বৈধ কাগজ আছে কি না, তা যাচাই করা, মালামাল চুরির বিষয়ে বিজিএমইএ, বিকেএমইএ ও এফবিসিসিআইয়ের যৌথ উদ্যোগে তদারকি টিম গঠন করা, যত্রতত্র গাড়ি তল্লাশি না করা, রপ্তানি মালামালবোঝাই গাড়িতে বিজিএমইএর স্টিকার ও মূল সড়কের বাইরে ডানে-বাঁয়ে যাওয়া বন্ধ করার যে প্রস্তাব দিয়েছে, তা–ও সরকারকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদেরও সজাগ থাকতে হবে, তঁারা যে যানবাহনে পণ্যটি পাঠাচ্ছেন, তা কতটা নিরাপদ ও নির্ভরযোগ্য।