ব্যবস্থাটি টেকসই ও ফলপ্রসূ হোক

স্কুলে শিশুদের খাবার দেওয়া

সরকার পরীক্ষামূলকভাবে কিছু প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করে সুফল পেয়েছে, এটি সুখবর। সংশ্লিষ্টদের তথ্য অনুযায়ী, যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের মধ্যে দুপুরের খাবার দেওয়া হতো, সেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঝরে পড়ার হার ৬ দশমিক ৬ শতাংশ কমেছে। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুই ধরনের খাবার দেওয়া হতো—শুকনো ও রান্না করা। সম্প্রতি মন্ত্রিসভার বৈঠকে ‘জাতীয় স্কুল মিল নীতি ২০১৯’–এর অনুমোদন দিয়েছে; যাতে বলা হয়েছে, শিশুদের পুষ্টি নিশ্চিত করতে পর্যায়ক্রমে দেশের সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করা হবে। দেশে বর্তমানে ৬৬ হাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১ কোটি ৪০ লাখ শিক্ষার্থী আছে। ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে এই কর্মসূচি বাস্তবায়ন শুরু হবে এবং ২০২৩ সালের মধ্যে দেশের সব প্রাথমিক বিদ্যালয় এই কর্মসূচির আওতায় আসবে।

সরকারের দাবি, এ কর্মসূচির আওতায় প্রাক্-প্রাথমিক ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ছে—এমন ৩ থেকে ১২ বছরের শিশুদের প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় শক্তি চাহিদার ক্যালরির ন্যূনতম ৩০ শতাংশ স্কুল মিল থেকে আসবে। এই কর্মসূচির সঙ্গে বিভাগ, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে জাতীয় স্কুল মিল কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের উপপরিচালক, জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার, উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার সহকারী উপপরিচালক, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষেত্রে পার্বত্য জেলা পরিষদ সম্পৃক্ত থাকবে বলে জানানো হয়েছে।

স্কুলপড়ুয়া ছেলেমেয়েদের পুষ্টি জোগানোর যেকোনো কর্মসূচিকে আমরা ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখতে চাই। প্রতিবেশী ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা প্রভৃতি দেশে এ ধরনের কর্মসূচি আছে এবং তারা সুফলও পেয়েছে। পেটে ক্ষুধা নিয়ে যে ভালোভাবে লেখাপড়া করা যায় না, সে কথা বলেছেন নোবেল বিজয়ী বাঙালি অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনও। তাঁর একটি নিবন্ধের নাম ‘আধা পেটে নামতা মুখস্থ’। দারিদ্র্যপীড়িত বাংলায় অতীতে বেশির ভাগ শিক্ষার্থী আধা পেটে খেয়ে পড়াশোনা করতে বাধ্য হতো। ব্রিটিশ আমল পেরিয়ে পাকিস্তান হয়েছে। পাকিস্তান ভেঙে আমরা বাংলাদেশ করেছি। কিন্তু দেশের সব মানুষকে এখনো দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র থেকে বের করে আনা যায়নি। সরকারি হিসাবেই ২২ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে। এর অর্থ হলো সাড়ে ৩ কোটি মানুষ তাদের মৌলিক ও মানবিক অধিকার থেকে বঞ্চিত।

দেশের সব বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীকে দুপুরের খাবার দেওয়া একটি বিরাট কর্মযজ্ঞ। বিশ্ব খাদ্য সংস্থার সহায়তায় গৃহীত এ কর্মসূচিতে ব্যয় হবে ৮ হাজার কোটি টাকা। এত বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীকে কী খাবার ও কী পদ্ধতিতে পরিবেশন করা হবে, সেটাই বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু সরকারি প্রশাসনযন্ত্রের মাধ্যমে শিশুদের খাবার দেওয়ার ব্যবস্থা করলে দুর্নীতি ও অনিয়ম হওয়ার সমূহ আশঙ্কা আছে। শিক্ষাবিদদের সঙ্গে সহমত পোষণ করে আমরাও বলতে চাই, এই কর্মসূচির সঙ্গে স্থানীয় জনগণ তথা অভিভাবকদের সম্পৃক্ত করতে হবে। পরীক্ষামূলক কর্মসূচিতে শিক্ষার্থীদের মায়েদের সম্পৃক্ত করা হয়েছে, যাঁরা সবচেয়ে ভালো জানেন সন্তানদের জন্য কী ধরনের খাবার দেওয়া প্রয়োজন। শুকনো কিংবা রান্না করা—যে খাবারই হোক না কেন, তা স্বাস্থ্যসম্মত হতে হবে। সে ক্ষেত্রে সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগকেও এর সঙ্গে যুক্ত করা যেতে পারে।

সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী কর্মসূচিসহ সরকারের অনেক কর্মসূচিতে দুর্নীতি-অনিয়মের গুরুতর অভিযোগ আছে। এখানেও যাতে তার পুনরাবৃত্তি না হয়, সরকারকে সেটি নিশ্চিত করতে হবে। তবে একটি সুস্থ ও সবল জাতি তৈরি করতে হলে শুধু স্কুলপড়ুয়া শিশু নয়, প্রতিটি নাগরিকের পুষ্টি চাহিদাও পূরণ করার দিকেই নজর দিতে হবে।