১৯৭৫ সালে জার্মানির বাঘ বিশেষজ্ঞ হেন রিডস সুন্দরবনের বাঘের ওপর জরিপ চালিয়ে বলেছিলেন, ওই ম্যানগ্রোভ বনে মোট ৩৫০টি বাঘ আছে। আর ২০১৭ সালে সুন্দরবনের বাঘের মল ও লোমের নমুনার জিনগত বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে যুক্তরাজ্যের কেন্ট বিশ্ববিদ্যালয় একটি সমীক্ষা চালিয়ে বলেছিল, সুন্দরবনে এখন বাঘের সংখ্যা ১২১। অর্থাৎ বিশ্বের সর্ববৃহৎ এই ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ৪২ বছরে এক-তৃতীয়াংশে নেমে এসেছে।
অবশ্য সুন্দরবনে বাঘের প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য পাওয়া যায়। ২০০৪ সালের বাঘশুমারি অনুযায়ী, বাংলাদেশে বাঘের সংখ্যা ছিল ৪৪০। ২০১৫ সালে প্রকাশিত দ্বিতীয় বাঘ জরিপের ফলাফলে বলা হয়, বাংলাদেশে বাঘের সংখ্যা কমে ১০৬টিতে দাঁড়িয়েছে। আর ইন্টারপোল ২০১৬ সালে বাংলাদেশ সরকারের কাছে ‘বাংলাদেশের সুন্দরবনে বাঘের বাণিজ্য’ শীর্ষক এক প্রতিবেদন পেশ করেছিল, যেখানে তারা বলেছিল, ২০০৪ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে সুন্দরবনের বাঘের সংখ্যা ৭৬ শতাংশ কমে গেছে।
সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা কমে যাওয়ার কারণ অনেক। সুন্দরবন এলাকায় শিল্প স্থাপন ও বাণিজ্য কর্মকাণ্ড বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাঘের বিপন্নতা বেড়ে চলেছে। এর পাশাপাশি রয়েছে সংগঠিতভাবে বাঘ শিকার করা। গত শুক্রবার প্রথম আলোয় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সুন্দরবনে প্রতিবছর গড়ে তিনটির বেশি বাঘ হত্যা করা হচ্ছে। বন্য প্রাণী সংরক্ষণবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘ট্রাফিক’ গত বুধবার বাঘের চামড়া, হাড়সহ অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আটক বিষয়ে এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যেখানে বলা হয়েছে, ২০০০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে ৫১টি বাঘ হত্যা করা হয়েছে। সংস্থাটি উল্লেখ করেছে যে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বছরে গড়ে দুটি করে বাঘ হত্যা করা হতো, কিন্তু তারপরের চার বছর ধরে তারা লক্ষ করছে যে এখন প্রতিবছর গড়ে তিনটির বেশি বাঘ হত্যা করা হচ্ছে।
সুন্দরবনে সংগঠিতভাবে বাঘ হত্যা করে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিদেশে পাচার করার বিষয়টি পুরোনো। এটি একটি স্থায়ী বাণিজ্যিক তৎপরতায় পরিণত হয়েছে এবং প্রতিরোধের যথাযথ উদ্যোগ না থাকায় তা অপ্রতিরোধ্যভাবে বেড়ে চলেছে। ইন্টারপোল আমাদের সরকারকে একাধিকবার এ বিষয়ে অবহিত করেছে। যেমন ২০১৬ সালের জানুয়ারি মাসে ইন্টারপোল বাংলাদেশ সরকারের কাছে সুন্দরবনের বাঘ হত্যা এবং ক্ষুদ্র অস্ত্রের সরবরাহ বিষয়ে দুটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছিল। সেখানে বলা হয়েছিল, সুন্দরবনের বাঘ হত্যায় একটি সংঘবদ্ধ চক্র সক্রিয় রয়েছে। এই চক্র সুন্দরবনে বাঘ হত্যায় অস্ত্র সরবরাহ, হত্যা শেষে বাঘের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ও চামড়া ভারতে পাচার করে। পাচারের সঙ্গে দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্যরাও জড়িত। ইন্টারপোলের প্রতিবেদনে বাঘ হত্যা এবং ডাকাত দলগুলোকে অস্ত্র সরবরাহকারী ৩২ ব্যক্তির নাম-পরিচয় উল্লেখ করা হয়েছিল, যার মধ্যে সুন্দরবন-সংলগ্ন এলাকার সরকারদলীয় একজন সাংসদ, ইউনিয়ন পরিষদের তিনজন চেয়ারম্যান এবং প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর বেশ কয়েকজন নেতার নাম ছিল।
সে সময় ইন্টারপোলের বাংলাদেশ শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেছিলেন, তাঁরা ইন্টারপোলের প্রতিবেদনটি সুন্দরবন-সংলগ্ন এলাকার পুলিশের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের কাছে পাঠিয়েছেন। তাঁরা অনুসন্ধান করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, বাঘ হত্যার হার আরও বাড়ছে। তাহলে তাঁরা কী ব্যবস্থা নিয়েছেন?
এভাবে বাঘ হত্যা চলছে এই কারণে যে এটি অত্যন্ত লাভজনক। সুতরাং বাঘ হত্যা ও বাঘের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ চোরাচালানে সক্রিয় সংঘবদ্ধ চক্রটিকে ধ্বংস করতে হবে। এই চক্রের স্থানীয় প্রভাবশালী অংশকে নিষ্ক্রিয় করতে হবে, সে জন্য কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক নেতৃত্বের কঠোর হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বা সীমান্ত রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত বাহিনীগুলোর জবাবদিহি নিশ্চিত করা একান্ত জরুরি। কারণ, তাদের কোনো অংশের যোগসাজশ থাকলে বাঘ হত্যা ও চোরাচালান বন্ধ হবে না।