কোভিড–১৯ মহামারির ফলে বাংলাদেশের চিকিৎসাব্যবস্থা এখন গুরুতর সংকটে। এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসার বন্দোবস্ত করতে গিয়ে গোটা চিকিৎসাব্যবস্থাই ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। সংবাদমাধ্যমে প্রতিদিন করোনাভাইরাসে সংক্রমিত ব্যক্তির সংখ্যা, মৃত্যুর হালনাগাদ পরিসংখ্যান, করোনা রোগীদের চিকিৎসার ক্ষেত্রে নানা সীমাবদ্ধতা ইত্যাদির খবর প্রকাশিত হচ্ছে। কিন্তু কোভিড-১৯ ছাড়াও যে অন্যান্য রোগব্যাধিতে অনেক মানুষ ভুগছে, তাদেরও যে চিকিৎসার প্রয়োজন—এ দিক থেকে যেন সবার দৃষ্টি সরে গেছে। উচ্চ রক্তচাপ, হৃদ্রোগ, ডায়াবেটিস, কিডনি ও লিভারের অসুখ, ক্যানসারসহ নানা ব্যাধিতে ভুগছে যেসব মানুষ, তাদের চিকিৎসায় ভীষণ সমস্যা হচ্ছে। বয়স্ক মানুষ, গর্ভবতী নারী ও শিশুদের আকস্মিকভাবে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়ার প্রয়োজন দেখা দিলে বড় রকমের অনিশ্চয়তায় পড়তে হচ্ছে।
অর্থাৎ, দেশের চিকিৎসাব্যবস্থা এখন স্বাভাবিকভাবে কাজ করছে না। গতকাল প্রথম আলোর প্রথম পাতায় খবর বেরিয়েছে, রাজধানীর বাইরে ২১টি সরকারি হাসপাতালে সাধারণ চিকিৎসাসেবা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। রাজধানীর সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোতেও চিকিৎসাসেবা স্বাভাবিক নেই। এর প্রধান কারণ চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যসেবাকর্মীদের করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার ঘটনা বেড়ে চলেছে। ইতিমধ্যে প্রায় ১০০ চিকিৎসক ও অর্ধশতাধিক নার্স করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। অনেক চিকিৎসককে হোম কোয়ারেন্টিন ও আইসোলেশনে থাকতে হচ্ছে। এমনিতেই আমাদের দেশে রোগীর তুলনায় চিকিৎসক-নার্সের সংখ্যা অপ্রতুল। এ অবস্থায় এতসংখ্যক চিকিৎসক-নার্স সংক্রমিত হওয়ায় চিকিৎসাক্ষেত্রে লোকবলের আরও ঘাটতি দেখা দিয়েছে।
এ রকম সংকটময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে, এমন আশঙ্কা চিকিৎসক মহলে আগেই লক্ষ করা গিয়েছিল। তাঁরা শুরু থেকেই বলে আসছিলেন, চিকিৎসক ও নার্সদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা নিশ্চিত না করা হলে তাঁদের অনেকে সংক্রমিত হতে পারেন, অনেককে আইসোলেশনে চলে যেতে হবে। ফলে চিকিৎসাব্যবস্থায় বিরাট ঘাটতি দেখা দেবে। কিন্তু তাঁদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা নিশ্চিত করা হয়নি। ফলে আমাদের চিকিৎসাব্যবস্থায় এ বিপজ্জনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। করোনা রোগীদের জন্য নির্ধারিত হাসপাতালগুলোতে নানা ঘাটতি, সীমাবদ্ধতা ও অব্যবস্থাপনার মধ্যেও এক রকমের চিকিৎসা কার্যক্রম চলছে; কিন্তু সারা দেশের সাধারণ চিকিৎসাব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে।
কিন্তু এ অবস্থা চলতে দেওয়া যায় না। করোনার জন্য নির্দিষ্ট হাসপাতালগুলোর বাইরে সরকারি-বেসরকারি সব চিকিৎসাপ্রতিষ্ঠানে স্বাভাবিক চিকিৎসাব্যবস্থা পুনরুদ্ধার করতে হবে। এ জন্য প্রথমেই চিকিৎসক-নার্সদের পর্যাপ্ত সুরক্ষা সরঞ্জামের সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে; দ্বিতীয়ত চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার উন্নয়নের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট সবার দায়িত্বশীলতা নিশ্চিত করতে হবে। করোনা রোগীর চিকিৎসা হচ্ছে না এমন কোনো হাসপাতালে গিয়ে কোনো সাধারণ রোগী যেন প্রয়োজনীয় চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত না হয়, তা সেই হাসপাতালের কর্তৃপক্ষকে নিশ্চিত করতে হবে।
আমাদের স্বাস্থ্য খাতের বৃহত্তর অংশই বেসরকারি। দুঃখজনকভাবে বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলো থেকেও এই করোনা সংকটের কালে সাধারণ রোগীরা চিকিৎসাসেবা পাচ্ছে না। অনেক বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক অনানুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ করা হয়েছে। প্রথম আলোর শনিবারের প্রতিবেদনে আটটি বেসরকারি ক্লিনিকের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যারা সব ধরনের চিকিৎসাসেবা বন্ধ করে দিয়েছে। এসব কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে নিজ নিজ চিকিৎসক-নার্সদের সুরক্ষা নিশ্চিত করেই স্বাভাবিক চিকিৎসাসেবা দেওয়া অব্যাহত রাখতে হবে।
সরকারি-বেসরকারি উভয় খাতেই স্বাভাবিক চিকিৎসাব্যবস্থা পুনরুদ্ধারের দিকে সরকারকে নজর দিতে হবে।