গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জের সাহেবগঞ্জ বাগদা ফার্মে ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর সাঁওতাল জাতিগোষ্ঠীর ওপর হামলা, সংঘর্ষ ও বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনাটি দেশব্যাপী তোলপাড় সৃষ্টি করেছিল। এই ঘৃণ্য হামলার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের দাবিতে নাগরিক সমাজসহ বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষ আন্দোলনেও নেমেছিলেন। কিন্তু দুই বছর আট মাস পর পুলিশ যে অভিযোগপত্র জমা দিয়েছে, তা বিচারপ্রার্থীদের মনে আশা জাগায়নি, হতাশ করেছে।
গত রোববার গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে সাঁওতালপল্লিতে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও হত্যা মামলায় ৯০ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। ভুক্তভোগী সাঁওতালেরা এই অভিযোগপত্র প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং প্রতিবাদে ওই দিনই গাইবান্ধা-দিনাজপুর সড়ক আড়াই ঘণ্টা ধরে অরবোধ করে রেখেছিলেন। তাঁরা ভবিষ্যতে আরও কর্মসূচি দেবেন বলেও জানিয়েছেন।
২০১৬ সালের নভেম্বরে ভাইরাল হওয়া ছবি ও ভিডিওতে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে মাথায় হেলমেট ও বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট পরা পুলিশ সদস্যদের সাঁওতালপল্লিতে বাঁশ ও শণের তৈরি ঘরে আগুন দিতে দেখা গেছে। বেসরকারি টেলিভিশনেও সেই ছবি প্রচারিত ও পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। ধারণা করি, ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিল বলেই ওই তিন পুলিশ কর্মকর্তাকে দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছিল।
এই প্রেক্ষাপটে পিবিআইয়ের অভিযোগপত্রে তাঁদের নাম না থাকার বিষয়টি সত্য আড়াল করার প্রয়াস ছাড়া কিছু নয়। তদন্তের নামে এ ধরনের প্রহসন কাম্য নয়। আগেও দেখা গেছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের কেউ জড়িত থাকলে তাঁদের রক্ষা করতে তদন্ত দল নানা কারসাজি ও অপকৌশলের আশ্রয় নিয়ে থাকে। পুলিশ বিভাগের কোনো সদস্যের অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত কিংবা বিচারের মুখোমুখি হওয়ার দায় পুরো পুলিশ বাহিনীর ওপর পড়ে না। বরং অপকর্মের সঙ্গে জড়িত পুলিশ কর্মকর্তাকে বাঁচাতে গেলে সেই দায় বাহিনীর ওপরই পড়ে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা নিজেই যদি আইনের নিজস্ব গতিকে এভাবে রুদ্ধ করে দেয়, তাহলে সাধারণ মানুষের ন্যায়বিচার পাওয়ার আর উপায় থাকে না। ভুক্তভোগী সাঁওতালদের দাবি, স্থানীয় সাবেক সাংসদ আবুল কালাম অজাদের নির্দেশে সাঁওতালপল্লিতে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটলেও পিবিআইয়ের তদন্তে তাঁর নামও বাদ দেওয়া হয়েছে। তাহলে প্রশ্ন আসে, কার নির্দেশে সেদিন পুলিশ বাহিনীর সদস্যসহ প্রভাবশালী ব্যক্তিরা দরিদ্র ও অসহায় সাঁওতালদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন?
গাইবান্ধার পুলিশ সুপার বলেছেন, ‘তাঁদের বিরুদ্ধে ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার কোনো প্রমাণ তদন্তে মেলেনি।’ যেখানে ভিডিওতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, তিন পুলিশ সদস্য সাঁওতালদের বাড়িঘরে আগুন দিচ্ছেন, সেখানে পিবিআইয়ের তদন্তে প্রমাণ না পাওয়া রহস্যজনক। তাঁর দাবি, ঘটনার রহস্য উন্মোচন, সঠিক তদন্ত ও মূল আসামিদের আইনের আওতায় আনতেই চার্জশিট দাখিলে কিছুটা সময় লেগেছে। আক্রান্ত সাঁওতালেরা সময় নিয়ে প্রশ্ন তোলেননি। প্রশ্ন তুলেছেন তদন্তের যথার্থতা নিয়ে। মামলাটির তদন্ত কার্যক্রম চলাকালে আটক ২৫ আসামির সবাই জামিনে বেরিয়ে এসেছেন।
এ রকম পক্ষপাতমূলক অভিযোগপত্র যেমন ন্যায়বিচারের পরিপন্থী, তেমনি পরবর্তী হামলার ক্ষেত্রও তৈরি করে। পুলিশের তদন্তকারী দল আক্রমণকারীর বাড়ি থেকে লুট করা সম্পদ উদ্ধার করেছে এবং ২৫ জন আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে বলে কৃতিত্ব দাবি করছে। কিন্তু সারা দেশের মানুষ ভিডিও ফুটেজের মাধ্যমে সাঁওতালদের বাড়িঘরে যাঁদের আগুন দিতে দেখল, তদন্তকারী দল তাদের খুঁজে পেল না? এই তদন্ত কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। আমরা সাঁওতালপল্লিতে হামলার ঘটনায় পিবিআইয়ের অভিযোগপত্র পুনর্বিবেচনার দাবি করছি।