সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়

মূল্যবৃদ্ধির পেছনে চাঁদাবাজি

সরকারের কি কিছু করার নেই

গুপ্ত ও প্রকাশ্য চাঁদাবাজির কারণে যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়ে যায়, সে বিষয়ে গত শনিবার ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভায় আলোচনা হয়েছে এবং তাঁরা পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তা তথা সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।

পণ্য পরিবহনে চাঁদাবাজি বেশ পুরোনো। ব্যবসায়ীদের ঘাটে ঘাটে চাঁদা দিতে হয়। দলীয় নেতা-কর্মীরা যে চাঁদা নেন, তা অনেকটাই প্রকাশ্য। চাঁদা না দিলে দোকান ও পণ্যের ট্রাক চলাচল বন্ধ করে দেওয়ার নজিরও কম নয়। প্রথম আলোর প্রতিবেদক গত শুক্রবার সরেজমিনে দেখেন, উত্তরার সিকদারবাড়ি থেকে সরকারি কর্মকর্তা আবাসিক এলাকা জামে মসজিদ পর্যন্ত আবদুল্লাহপুর-আঁটিপাড়া সড়কের ৩০০ মিটার অংশে অস্থায়ী দোকান আছে ১২০টি। ব্যবসায়ীদের ভাষ্য অনুযায়ী, এসব দোকান থেকে প্রতিদিন ৩০০ থেকে ৯০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা নেওয়া হয়। মাসে আদায় হয় ১৮ লাখ টাকা। আর এ চাঁদা তোলেন স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতা। উদ্বেগের বিষয় হলো ঢাকা শহরে এ রকম অস্থায়ী দোকান ও বাজার বসিয়ে হরদম চাঁদাবাজি চললেও সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানা যায় না।

আর গুপ্ত চাঁদাবাজির সঙ্গে সরাসরি জড়িত থানা-পুলিশ ও হাইওয়ে পুলিশ। এফবিসিসিআইয়ের সভায় অনলাইনে যুক্ত হয়ে রংপুর চেম্বারের সভাপতি মোস্তফা সোহরাব চৌধুরী বলেন, রংপুর থেকে রাজধানীতে পণ্য পাঠাতে পথে পথে পুলিশকে চাঁদা দিতে হয়। এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বলেছেন, ঘাটে ঘাটে চাঁদা দিতে হচ্ছে। তিনি সভার মতামত সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে জানানোর পাশাপাশি পুলিশ প্রধানের সঙ্গে বসতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।

তবে চাঁদাবাজির বিষয়ে ঢাকার একজন দায়িত্বশীল পুলিশ কর্মকর্তা যা বলেছেন, তা শাক দিয়ে মাছ ঢাকার ব্যর্থ চেষ্টামাত্র। তিনি চাঁদাবাজির অভিযোগ না করে ব্যবসায়ীদের প্রতি সুনির্দিষ্ট তথ্য দেওয়ার অনুরোধ করেছেন। তাঁর এ বক্তব্যের জবাবে বলতে হয়, কেউ জেগে ঘুমিয়ে থাকলে তাকে জাগানো যায় না। বাংলাদেশের যেকোনো সড়কে কিছু সময় দাঁড়ালেই খোলা চোখে দেখা যাবে পুলিশ কীভাবে ট্রাক, বাস আটকে চাঁদা ও উৎকোচ আদায় করে। ওই পুলিশ কর্মকর্তার বক্তব্যে দুর্ভাগ্যজনকভাবে পেশাদারি মনোভাবেরও প্রতিফলন ঘটেনি। ব্যবসায়ীরা যে পরিস্থিতির মুখোমুখি হন প্রতিদিন, তা নিয়ে তাঁরা শুধু অভিযোগই করতে পারেন পুলিশ বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে। পুলিশের কাজ অভিযোগ খতিয়ে দেখা এবং তথ্যপ্রমাণ খুঁজে বের করা। এখন পুলিশ যদি নিজেদের অপকর্ম দেখতে না চায়, তাহলে ভিন্ন কথা। তা না হলে সবাই যা দেখে এবং জানে, তা পুলিশ জানে না কেন? কেন তথ্যপ্রমাণ নিয়ে তাদের কাছে হাজির হতে হবে?

দু-চারজন চাঁদাবাজিতে জড়িত থাকতে পারেন বলে পুলিশ কর্মকর্তা যে মন্তব্য করেছেন, তা সত্যের অপলাপ। বাস্তবতা বা ব্যবসায়ীদের অভিজ্ঞতা অবশ্য তা বলে না। ট্রাক-বাস আটকে চাঁদা আদায় বন্ধ করতে হলে আগে সত্য স্বীকার করে নিতে হবে। ২০১৩ সালে প্রথম আলোর প্রতিবেদক বগুড়ার মহাস্থানগড় থেকে চট্টগ্রামের রিয়াজউদ্দিন বাজারে এক পণ্যবাহী ট্রাকের সহযাত্রী হয়ে দেখেছিলেন, ঘাটে ঘাটে কীভাবে পুলিশ চাঁদা নেয়। সে সময় বগুড়া থেকে চট্টগ্রামে ট্রাকভাড়া ছিল ৩০ হাজার টাকা আর ঘাটে ঘাটে চাঁদা গুনতে হয়েছে ২২ হাজার টাকা।

গত আট বছরে পণ্য পরিবহনে প্রকাশ্য বা গুপ্ত চাঁদাবাজি কমেনি, বরং বেড়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মনে রাখা প্রয়োজন, পরিবহনে যে চাঁদাবাজি হয়, সেটি ব্যবসায়ীরা পকেট থেকে দেন না। চূড়ান্ত বিচারে ভোক্তাকেই এর দায় বহন করতে হয়। প্রশ্ন হলো এফবিসিসিআইয়ের বৈঠকে গুপ্ত চাঁদাবাজি নিয়ে যে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে, সেটি সরকার আমলে নেবে কি না। আমলে নিলে গণপরিবহনে চাঁদাবাজি পুরোপুরি বন্ধ করতে না পারলেও কমিয়ে আনা যাবে বলে আমরা মনে করি।