দেশের উন্নয়ন হোক সমতাভিত্তিক

সবকিছু কেন ঢাকাকেন্দ্রিক

সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়

নিরাপদ সড়কের দাবিতে যখন বিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করছেন, তখন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) আয়োজিত সেমিনারে ঢাকা মহানগরীর সড়ক অবকাঠামোর রুগ্‌ণ ও বিবর্ণ চিত্রই উঠে এসেছে।

একদা কৃষিভিত্তিক বাংলাদেশে জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ গ্রামে বাস করত। কিন্তু দ্রুত শিল্পায়নের কারণে শহরে লোকসংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। শিল্পায়নের এ ধারা সমতাভিত্তিক নয়, অসম। বর্তমানে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে যে উন্নয়নযজ্ঞ চলছে, তা অনেকটাই রাজধানী ও এর আশপাশের শহরভিত্তিক। আবার এককেন্দ্রিক বাংলাদেশের প্রশাসনিক কাঠামোও ঢাকাকেন্দ্রিক। আগে গুটিকয় সরকারি দপ্তরের সদর দপ্তর বাইরে ছিল; এখন সবটাই ঢাকায়। ফলে মানুষ শুধু কাজের উদ্দেশ্যেই ঢাকায় আসছে না; তার দৈনন্দিন প্রয়োজনেও ঢাকায় আসতে হয়।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৩০ লাখ ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে ঢাকায় বসবাস করছে ১ কোটি ৮৯ লাখ মানুষ। দেশের মোট শহুরে জনসংখ্যার প্রায় ৩২ শতাংশ বসবাস করছে রাজধানীতে। ১০ লাখের বেশি মানুষ বাস করে এমন শহর বাংলাদেশে মাত্র পাঁচটি। অন্যদিকে চীনে এমন শহরের সংখ্যা ১০২, ভারতে ৫৪, ইন্দোনেশিয়ায় ১৪, পাকিস্তানে ১০ ও ভিয়েতনামে ৭টি।

এ ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার জন্য যে অবকাঠামো ও যোগাযোগব্যবস্থা প্রয়োজন, তা ঢাকা শহরে নেই। ফলে শহরে নিত্য যানজট লেগে আছে। পিআরআইয়ের গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকার যানজটের কারণে দেশের জিডিপিতে প্রতিবছর ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে ২ দশমিক ৫ শতাংশে। পরোক্ষ ক্ষতি যোগ করে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৫ দশমিক ৮ শতাংশে। ঢাকা শহরের রাস্তাগুলোয় যে পরিমাণ গাড়ি চলাচলের ক্ষমতা, চলাচল করে তার ৩০-৪০ শতাংশ বেশি। একজন বিশেষজ্ঞ ঢাকার পরিবহনব্যবস্থা আইসিউতে আছে বলে মন্তব্য করেছেন। এর পাশাপাশি ডেইলি স্টার প্রধান শিরোনাম করেছে, গণপরিবহন নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা খারাপ থেকে খারাপতর হয়েছে।

সব মিলিয়ে ঢাকা শহর বসবাস ও যোগাযোগের জন্য অসহনীয় হয়ে পড়েছে। এ থেকে রেহাই পাওয়ার উপায় কী? সরকার ঢাকা শহরের যানজট কমাতে মেট্রোরেল নির্মাণ করছে, পাতালরেল বসানোরও উদ্যোগ নিয়েছে। এগুলোর কাজ শেষ হতে ঢাকায় জনসংখ্যা আরও বাড়বে। আর মানুষ তো কেবল রাস্তায় চলবে না। তাদের থাকার জন্য আবাসন প্রয়োজন হবে, স্বাস্থ্যসেবার জন্য হাসপাতাল, শিক্ষার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এসব অবকাঠামো নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় জায়গা তিন দিকে নদীবেষ্টিত ঢাকা শহর বা এর আশপাশে নেই।

অতএব, পুরো উন্নয়ন পরিকল্পনা নিয়ে সরকারকে নতুন করে ভাবা উচিত। কর্মসংস্থান আছে বলেই মানুষ দলে দলে ঢাকায় আসছে। আমরা মুখে ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা বললেও প্রশাসনিক কাঠামোটি এমন কেন্দ্রীভূত যে স্কুল-কলেজশিক্ষকদের বেতনের ছাড়পত্র নিতেও তাঁদের ঢাকায় আসতে হয়। চট্টগ্রামকে বাণিজ্যিক রাজধানী ঘোষণা করা হয়েছিল অনেক আগে। কিন্তু প্রশাসনিক সুবিধা না থাকায় সেখানকার ব্যবসায়ীরাও ঢাকামুখী। ঢাকার বাইরে যেসব শহর আছে, সেখানে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড খুবই সীমিত। নাগরিক সুযোগ-সুবিধা আরও কম। ফলে ঢাকায়ই সবাই ভিড় জমাচ্ছে। এটি দেশের অর্থনীতি কিংবা জনগণের জন্যও কল্যাণকর নয়। এ অবস্থায় ঢাকাকেন্দ্রিক উন্নয়নচিন্তা বাদ দিয়ে সমতাভিত্তিক উন্নয়নের দিকেই আমাদের মনোযোগ দিতে হবে।