শিক্ষা খাতে দুর্নীতি

সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) গবেষণা প্রতিবেদনে শিক্ষা খাতের সার্বিক যে চিত্র উঠে এসেছে, তা এককথায় ভয়াবহ। প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা—সর্বত্র দুর্নীতি, অনিয়ম, অব্যবস্থা জেঁকে বসেছে।

টিআইবির প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের মাধ্যমিক শিক্ষায় এমপিওভুক্তি, নিয়োগ, বদলি, পাঠদানের অনুমতিসহ বিভিন্ন কাজে ৫ হাজার থেকে শুরু করে ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত নিয়মবহির্ভূত (ঘুষ) দিতে হয়। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) ও এর অধীন বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটি, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, প্রধান শিক্ষক থেকে শুরু করে শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের এ ঘুষ দিতে হয়। এ ছাড়া বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারীদের এমপিওভুক্তির (মাসে বেতন বাবদ সরকারি টাকা) কাজে চার স্থানে ‘হাদিয়া বা সম্মানী’ দিতে হয়। এ কাজে পাঁচ হাজার থেকে শুরু করে এক লাখ টাকা পর্যন্ত নিয়মবহির্ভূত দিতে হয়।

২০১০ সালে ঘোষিত জাতীয় শিক্ষানীতিতে শিক্ষা প্রশাসনে কাঠামোগত পরিবর্তন আনার কথা বলা হয়েছিল। যুগের চাহিদা মেটাতে পারে এমন শিক্ষাক্রম চালু ও উপযুক্ত শিক্ষক নিয়োগের ওপর জোর দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের জন্য যে আইন দরকার, গত বছরেও তা খসড়া পর্যায়ে আছে। নোট বই, গাইড বই থাকবে কি থাকবে না, কোচিং সেন্টার চলবে কি চলবে না, সেই বিতর্কেই সময় চলে গেল। ইতিমধ্যে শিক্ষামন্ত্রী পদে পরিবর্তন এল। ২০২২ সাল থেকে পাঠক্রম পরিবর্তনের পরিকল্পনা ঘোষিত হয়েছে। কিন্তু শিক্ষাকাঠামোয় কোনো পরিবর্তন আসেনি। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সহকারী শিক্ষক নিয়োগ বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে হলেও অধ্যক্ষ, প্রধান শিক্ষক ও সহকারী প্রধান শিক্ষক নিয়োগ হচ্ছে আগের নিয়মেই, যেখানে ঘুষ ও রাজনৈতিক প্রভাব দুটোই সক্রিয়। জাতীয় শিক্ষানীতিতে বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগ কমিশন গঠনের কথা বলা হয়েছিল, তা–ও অদ্যাবধি কার্যকর হয়নি।

টিআইবির জরিপ গবেষণাটি তৈরি হয় ভুক্তভোগীদের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে, যদিও সংস্থার নীতি অনুযায়ী তাঁদের নাম প্রকাশ করা হয় না। শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী স্বীকার করেছেন, সার্বিকভাবে শিক্ষা প্রশাসনে দুর্নীতি একটি চ্যালেঞ্জ। কারও দোষের জন্য দ্রুত ব্যবস্থা নিতে না পারলে এ ধরনের অভিযোগ ও ধারণা কমবে না। তাই শিক্ষা প্রশাসনে কাঠামোগত পরিবর্তন দরকার এবং তারা সেই চেষ্টা করছে।

কিন্তু একটানা ১২ বছর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার পরও যদি ‘আনা হবে’, ‘করা হবে’ ইত্যাদি আপ্তবাক্য শুনতে হয়, তার চেয়ে দুর্ভাগ্যের কী থাকতে পারে? শিক্ষা প্রশাসনে দুর্নীতি যখন বড় চ্যালেঞ্জ, সেটি মোকাবিলার চেষ্টা করা হচ্ছে না কেন? টিআইবির প্রতিবেদনটি ভিত্তি হিসেবে ধরেই সরকার সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারে। ঘুষখোরদের জামাই আদরে রেখে মুখে যত বড় কথাই বলুন না কেন, শিক্ষা খাতে দুর্নীতি কমানো যাবে না।

টিআইবির প্রতিবেদনে কেবল শিক্ষা বিভাগের দোষ খোঁজা হয়নি, সমস্যা সমাধানের ২০ দফা সুপারিশও করা হয়েছে। সরকার এই সুপারিশকে ভিত্তি ধরেও কাঠামোগত সংস্কারের কাজটি করতে পারে। সর্বশেষ শিক্ষা খাতে অপ্রতুল বরাদ্দের কথাও বলতে হয়। টাকার অঙ্কে যা-ই হোক না কেন, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শিক্ষা খাতে বাংলাদেশের বরাদ্দের হার কম। আশা করি, এদিকেও নীতিনির্ধারকেরা দৃষ্টি দেবেন। শিক্ষা বিভাগে সব ধরনের ‘হাদিয়া সংস্কৃতি’ বন্ধ হোক।