শাহবাজ শরিফের পায়ের নিচে পিচ্ছিল পথ

শাহবাজ শরিফ যে জোটের ওপর ভর করে প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন, সেই জোটে ঐক্যের অভাব আছে। ফলে টিকে থাকতে হলে তাঁকে সতর্কভাবে পা ফেলতে হবে
ছবি: রয়টার্স

পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) নেতা ইমরান খানকে অনাস্থা ভোটের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে অপসারণের কারণে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা ও অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়েছিল। এর মধ্য দিয়েই পাকিস্তান মুসলিম লিগ-নওয়াজের (পিএমএল-এন) সভাপতি শাহবাজ শরিফ পাকিস্তানের ২৩তম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন।

শাহবাজ শরিফ যখন গদিতে বসলেন, ঠিক সেই সময়ে পাকিস্তান বড় ধরনের সংকটকাল পার করছে। উত্তরাধিকারসূত্রে তাঁর সামনে এখন একটি ক্ষয়িষ্ণু অর্থনীতি, সমস্যাযুক্ত বৈদেশিক সম্পর্ক এবং পরস্পর বিবাদে লিপ্ত একটি রাজনৈতিক জোট। ১১টি রাজনৈতিক দলের এই ভঙ্গুর জোটের ওপরে দাঁড়িয়ে তাঁকে চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে হবে।

ভুলে গেলে চলবে না, শুধু ইমরান খানকে ক্ষমতা থেকে অপসারণের সাধারণ লক্ষ্যে এ জোটে এসে সবাই হাত মিলিয়েছেন। ইমরান হটানোর ইস্যুতে তাঁরা এক হলেও তাঁদের নিজেদের মধ্যে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির তীব্র বিরোধিতা আছে।

পিটিআই সরকারের অন্যতম প্রধান ত্রুটি ছিল দলটি তার বেশির ভাগ নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি, বিশেষ করে অর্থনীতি, সুশাসন, দুর্নীতি নির্মূল ও কর্মসংস্থানবিষয়ক প্রতিশ্রুতিগুলো পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছিল। ইমরান খানের সরকার ক্ষমতার যথেচ্ছ ব্যবহারের জন্যও সমালোচিত হয়েছিল। প্রধান নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে পার্লামেন্টকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া এবং তার পরিবর্তে প্রেসিডেন্টের অধ্যাদেশের মাধ্যমে শাসন করার জন্য ইমরান সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন। কার্যকরভাবে দেশকে নেতৃত্ব দিতে পিটিআইয়ের ব্যর্থতার কারণে বিভিন্ন জায়গায়, বিশেষ করে বৃহত্তম প্রদেশ পাঞ্জাবে শাসনসংক্রান্ত সমস্যা দেখা দেয়।

সে ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফকে অবশ্যই শাসনব্যবস্থার উন্নতির বিষয়কেই অগ্রাধিকার দিতে হবে। আর শাসনব্যবস্থার উন্নয়নের কাজটিই তিনি সবচেয়ে ভালো করতে পারেন। তিনি এর আগে পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। সেখানে তিনি তিন মেয়াদে এ পদে ছিলেন এবং একজন ‘করিতকর্মা’ প্রশাসক হিসেবে খ্যাতিও অর্জন করেছিলেন।

তবে বর্তমান রাজনৈতিক পরিবেশে কেন্দ্র থেকে দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে শাহবাজ শরিফের সামনে বেশ কিছু ভিন্ন চ্যালেঞ্জ দেখা দেবে। পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শরিফ কেন্দ্রীয় সরকারের সমর্থন পেয়েছিলেন। কিন্তু বর্তমান ভূমিকায় তাঁকে তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপের আগে সমর্থনের জন্য ১১টি শরিক দলের দ্বারস্থ হতে হবে। এই ১১টি দলের অ্যাজেন্ডা আলাদা। প্রতিটি দলই ভালো করে জানে, তাদের জোট সম্ভবত স্বল্পস্থায়ী হবে এবং আগামী নির্বাচনে তারা একে অপরের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে।

২০২৩ সালের নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে শরিফ সরকারকে অবশ্যই অগ্নিনির্বাপকদের মতো তাড়াহুড়া করা আচরণ পরিহার করতে হবে। দেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক সমস্যাগুলো সমাধানে স্বল্পমেয়াদি লক্ষ্য অর্জনের প্রলোভন পরিহার করতে হবে। তবে এটি সত্য, এসব করার চেয়ে বলা অনেক সহজ। শাহবাজ শরিফ কতটুকু বলবেন এবং কতটুকু করবেন, তা সময়ই বলে দেবে।

এ কথা ঠিক, শাহবাজ শরিফ পাঞ্জাব প্রদেশ শাসনের তাঁর দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে উপকৃত হবেন। তবে তাঁকে খেয়াল রাখতে হবে, পাঞ্জাবে তিনি যা কিছু করেছিলেন, তা হুবহু নকল করে দেশ চালানো যাবে না। এ চিন্তা মাথায় রাখা যাবে না। কারণ, কেন্দ্র শাসনে সফল হওয়ার জন্য আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতির প্রয়োজন হবে। তাঁর জোটের মধ্যে বিভেদের যেকোনো লক্ষণকেই পিটিআই সুযোগ হিসেবে নেবে। সেই বিভক্তি পিটিআইয়ের ভাষ্যকে শক্তি জোগাবে।

পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক পরিসর শাহবাজ শরিফের সরকারের জন্য সীমিতই থাকবে। দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি বেশ কিছু দৃঢ় এবং উচ্চাভিলাষী বিদেশনীতির রূপরেখা দিয়েছেন। তবে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি যেহেতু এক বছর সময় পাবেন, সেহেতু তিনি সম্ভবত সাফল্য অর্জনের বদলে বিদ্যমান দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভারসাম্যের দিকে মনোনিবেশ করবেন।

পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে শরিফের চীনের সঙ্গে যে ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, তা তাঁকে বেইজিং-ইসলামাবাদ সম্পর্ক জোরদারে সাহায্য করবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে ক্রমবর্ধমান প্রতিদ্বন্দ্বিতা শাহবাজ শরিফকে দুটি বৈশ্বিক শক্তির সঙ্গে সতর্কভাবে একটি জটিল ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে চাপ দেবে।

ঐতিহাসিকভাবে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে পররাষ্ট্রনীতির বিষয়গুলো কখনোই উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেনি। কিন্তু এ মুহূর্তে পিটিআই পাকিস্তানের রাজনীতিতে বিদেশি হস্তক্ষেপের অভিযোগ তুলেছে এবং ইমরান খানের সরকারকে উৎখাত করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের হাত রয়েছে বলে অভিযোগ করেছে। এ অভিযোগের ভিত্তিতে পিটিআই নতুন সরকারের বিরুদ্ধে প্রচার চালাচ্ছে। দলটি পরবর্তী নির্বাচন মাথায় রেখে এ প্রচারণা তৈরি করছে। পিটিআই বিদেশি হস্তক্ষেপের অভিযোগের প্রমাণ হিসেবে ওয়াশিংটন বা নয়াদিল্লির সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য শাহবাজ শরিফ যেকোনো পদক্ষেপ নিতে পারেন—এ ভাষ্য জনগণের সামনে উপস্থাপন করবে। এ কারণে শরিফের স্বল্প মেয়াদের সরকারের পররাষ্ট্রনীতি তাঁর অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ওপর প্রভাব বিস্তার করবে।

পিটিআই সরকারের ত্রুটিযুক্ত অর্থনৈতিক পদক্ষেপ, বৈশ্বিক মহামারি এবং সর্বশেষ ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পাকিস্তানের আর্থিক অবস্থা নাজুক হয়ে পড়েছে। ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি এবং দ্রব্যমূল্যের ধারাবাহিক ঊর্ধ্বগতি থামিয়ে স্বস্তি ফিরিয়ে আনা হবে নতুন সরকারের কাছে মূল প্রত্যাশা।

উদ্ভূত রাজনৈতিক পরিবেশে পরিস্থিতি নিজের অনূকুলে নিতে সম্ভবত শরিফ সরকারকে কিছু স্বল্প মেয়াদি প্রতিকারের পথে হাঁটতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকার পুনর্গঠিত বেনজির ইনকাম সাপোর্ট প্রোগ্রামের অধীনে জনগণের মধ্যে নগদ টাকা বিতরণের মতো কিছু পরীক্ষিত উদ্যোগ নিতে পারে। শাহবাজ ইতিমধ্যে সরকারি কর্মচারীদের বেতন বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন। সরকারি কোষাগারের অবস্থা খারাপ থাকার পরও তাঁকে পরিস্থিতি বিবেচনায় এ সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। তবে এ ধরনের উদ্যোগ অনেক সময় জনগণের মধ্যে উল্টো অসন্তোষ সৃষ্টি করতে পারে। কারণ, সরকারি বেতন বাড়লেও বেসরকারি কর্মীদের আয় বাড়ছে না। তাতে আর্থিক ব্যবধান আরও বেড়ে যায়।

আসন্ন বছরটি পাকিস্তানের রাজনীতিতে একটি উত্তাল সময় হবে। কারণ, শাহবাজ শরিফের সরকার এবং তাঁর নীতি-উদ্যোগকে দুর্বল করার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করবে পিটিআই।

২০২৩ সালের নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে শরিফ সরকারকে অবশ্যই অগ্নিনির্বাপকদের মতো তাড়াহুড়া করা আচরণ পরিহার করতে হবে। দেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক সমস্যাগুলো সমাধানে স্বল্পমেয়াদি লক্ষ্য অর্জনের প্রলোভন পরিহার করতে হবে। তবে এটি সত্য, এসব করার চেয়ে বলা অনেক সহজ। শাহবাজ শরিফ কতটুকু বলবেন এবং কতটুকু করবেন, তা সময়ই বলে দেবে।

আল-জাজিরা থেকে নেওয়া, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

সিতারা নূর পাকিস্তানের ইসলামাবাদে সেন্টার ফর অ্যারোস্পেস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের একজন সিনিয়র গবেষক