বাংলাদেশের লোকশিল্পের সংরক্ষণ, বিকাশ ও সর্বসাধারণের মধ্যে লোকশিল্পের গৌরবময় দিক তুলে ধরার জন্য ১৯৭৫ সালে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের উদ্যোগে সরকার নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করে। এখানে সংরক্ষিত রয়েছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের কারুশিল্পীদের হাতে তৈরি ঐতিহ্যবাহী অনেক নিদর্শন। এসব নিদর্শন আমাদের সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। কিন্তু যে উদ্দেশ্য নিয়ে ফাউন্ডেশনটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল তা মনে হয় এখন ভেস্তে যেতে বসেছে। প্রথম আলোতে প্রকাশিত এক খবরের তথ্য অনুযায়ী, ফাউন্ডেশন কর্তৃপক্ষের অযত্ন ও অবহেলায় অনেক ঐতিহ্যবাহী লোক ও কারুশিল্প এবং প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
সংরক্ষণের অভাব ও অযত্ন-অবহেলায় ফাউন্ডেশনের শিল্পাচার্য জয়নুল লোক ও কারুশিল্প জাদুঘর ও সরদারবাড়ি জাদুঘরের নকশিকাটা কাঠের দরজা ও খাট ঘুণ ও উইপোকায় খেয়ে নষ্ট করে ফেলেছে। এ ছাড়া ফাউন্ডেশনের গুদামে রক্ষিত শতাধিক বিভিন্ন পুরোনো নিদর্শনের অধিকাংশ ঘুণ ও উইপোকার কবলে পড়ে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।
লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন কর্তৃপক্ষের এ ধরনের অবহেলার জবাব কী? ফাউন্ডেশনের ১৯৯৮ সালের আইনের ৮ নম্বর অনুচ্ছেদের কার্যাবলির শর্ত অনুযায়ী ফাউন্ডেশন কর্তৃপক্ষের প্রধান কাজ হবে ঐতিহাসিক এবং লোক ও কারুশিল্পের সংরক্ষণ করা। এ ছাড়া কারুশিল্প বিষয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে লোক ও কারুশিল্প জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা, ফাউন্ডেশনের ভেতরে একটি শিল্পগ্রাম প্রতিষ্ঠা করা, লোক ও কারুশিল্প বিষয়ে গবেষণার ব্যবস্থা করা, কারুশিল্পের সার্বিক উন্নয়নে কাজ করাও শর্তের মধ্যে ছিল। কিন্তু দেখা গেছে, ফাউন্ডেশন কর্তৃপক্ষ তাদের এসব কাজের অধিকাংশেরই বাস্তবায়ন করেনি। এর মধ্য দিয়ে স্পষ্টতই ফাউন্ডেশন আইন ভঙ্গ করেছে।
বাংলাদেশের লোক ও কারুশিল্পের দীর্ঘ ইতিহাস আছে। মসলিন শাড়ি থেকে শুরু করে নকশিকাঁথা, শীতলপাটি, বিয়ের পিঁড়ি, বাঁশ-বেত দিয়ে তৈরি শিল্প এবং পোড়ামাটির শিল্প আমাদের ঐতিহ্যের মূর্ত প্রতীক। সেই সঙ্গে গৌরবেরও। এগুলোর বিলুপ্তির অর্থ হচ্ছে দেশের ইতিহাস ও অতীত গৌরবকে ধ্বংস করা।
এটা খুবই হতাশার বিষয় যে দেশের ঐতিহ্যবাহী নিদর্শন ও প্রত্নসম্পদ রক্ষায় সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সংস্থাগুলো বরাবরই বেশ উদাসীন। দীর্ঘদিন ধরে তাদের এ উদাসীনতার কারণে আমরা নিজস্ব অনেক ঐতিহ্য আজ হারাতে বসেছি। কিন্তু সেটা তো হতে দেওয়া যায় না। সরকারকে এ ব্যাপারে সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে হবে। সরকারের যেসব মন্ত্রণালয় ও সংস্থা প্রত্নসম্পদ ও ঐতিহ্যবাহী নিদর্শন রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে নিয়োজিত, তারা তাদের কাজ ঠিকমতো করছে কি না, সে ব্যাপারে নজরদারি বাড়াতে হবে। কাজে গাফিলতির জন্য প্রয়োজনে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। এ ছাড়া পুরোনো নিদর্শন রক্ষার জন্য বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করা, প্রশিক্ষণ প্রদানসহ প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নিতে হবে।