লালমনিরহাটে নৃশংস হত্যা

সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়

গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার বুড়িমারীতে আবু ইউনুস মোহাম্মদ শহীদুন্নবী নামের ৫০ বছর বয়সী এক ব্যক্তিকে দলবদ্ধভাবে পিটিয়ে ও পুড়িয়ে হত্যা করার ঘটনায় দেশজুড়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যাচ্ছে। কারণ, ‘ধর্মের অবমাননার অভিযোগে’ এ ধরনের নৃশংসতায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে যে মধ্যযুগীয় মানসিকতা কাজ করে, তাতে যেকোনো ব্যক্তির জীবন আকস্মিকভাবে এমন মর্মান্তিক পরিণতির শিকার হতে পারে। এটা ভীষণ ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি; এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঠেকানোর জন্য সরকার, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সমাজের মানুষকে সর্বতোভাবে চেষ্টা করতে হবে।

সে জন্য প্রথমেই নিশ্চিতভাবে জানা প্রয়োজন লালমনিরহাটে প্রকৃতপক্ষে কী ঘটেছে। পুলিশ ও কিছু এলাকাবাসীর প্রাথমিক ভাষ্য অনুযায়ী, পবিত্র কোরআন অবমাননার অভিযোগ রটানোর পেছনে কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা মহলের ইন্ধন বা পরিকল্পনা ছিল কি না, তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। কারণ, আমরা অতীতে একাধিক স্থানে দেখেছি ধর্মের অবমাননা করা হয়েছে বলে পরিকল্পিতভাবে গুজব রটিয়ে দলবদ্ধ সহিংসতা উসকে দেওয়া হয়েছে।

স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশ বিভাগের সমন্বয়ে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগসহ অন্যান্য সংস্থা ঘটনার পরদিন থেকেই তদন্ত শুরু করেছে বলে শুক্রবারেই খবর পাওয়া গেছে। শনিবার তিনটি মামলা দায়ের ও পাঁচ ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেল। তদন্তের স্বার্থে গ্রেপ্তার ব্যক্তির সম্পর্কে পুলিশ কিছু জানানো থেকে আপাতত বিরত রয়েছে বলে বলা হয়েছে। তিন সদস্যের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন আজই পেশ করার কথা। আমরা আশা করব প্রকৃতপক্ষে কী ঘটেছে, তার আদ্যোপান্ত পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে জানা সম্ভব হবে এবং তা জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে। এ জন্য আরও বিশদ তদন্তের প্রয়োজন হলে তার জন্য যদি আরও সময় লাগে তবে সে সময় নেওয়া হোক, তবু প্রকৃত ঘটনা সম্পর্কে জানা ও তা জনসাধারণকে জানানো একান্ত প্রয়োজন।

রংপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে এ নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ ও অপরাধীদের শাস্তির দাবিতে মানববন্ধন ও অন্যান্য কর্মসূচি চলছে। এটাই স্বাভাবিক, কারণ এ ধরনের দলবদ্ধ সহিংসতা কোনো কারণে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এসবের বিরুদ্ধে সমাজের জনমত সংগঠিত করার লক্ষ্যে যেমন সচেতনতা সৃষ্টি করা প্রয়োজন, তেমনই অপরাধ সংঘটিত হলে অপরাধীদের আইনানুগভাবে বিচার করে শাস্তি নিশ্চিত করাও একান্ত জরুরি। অনেক নাম না জানা মানুষের সংঘবদ্ধ আক্রমণে কোনো ব্যক্তির নিহত হওয়ার ঘটনায় হত্যাকারীদের সুনির্দিষ্টভাবে শনাক্ত করে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো কঠিন কাজ হলেও সেই চেষ্টা সর্বাত্মকভাবে করা দরকার। এ রকম ক্ষেত্রে বিপুলসংখ্যক মানুষকে আসামি করে নিরপরাধ মানুষকে হয়রানির যে আশঙ্কা থাকে, তা–ও দূর করা দরকার। সে কারণেই সুষ্ঠু, সঠিক, গভীর ও বিশদ তদন্তকাজ একান্ত প্রয়োজন।

সেই সঙ্গে সমাজে এমন ধারণা আরও জোরালো করার উদ্যোগ নিতে হবে যে কোনো কারণেই কোনো মানুষকে শারীরিকভাবে আক্রমণ করা উচিত নয়। যেকোনো বিরোধ, বিতর্ক, অপরাধ সংঘটিত হলে তার প্রতিকারের জন্য দেশে আইন আছে, আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষ আছে এবং বিচারব্যবস্থা আছে। যে দায়িত্ব আইন ও বিচারব্যবস্থার, তা কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর জনতার নিজের হাতে তুলে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। বরং তা আইনের দৃষ্টিতে অপরাধ। তা ছাড়া সব বিষয়ে সমাজে সহিষ্ণুতা ও বিচারবুদ্ধি প্রয়োগের ওপর বিশেষ জোর দেওয়া উচিত। এ জন্য শিক্ষিত ও সচেতন যুবসমাজ এবং সমাজের সব স্তরের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের ভূমিকা রয়েছে। দলবদ্ধ সহিংসতার বিপজ্জনক প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসার সর্বাত্মক প্রয়াসের কোনো বিকল্প নেই।