খুনি ও নেপথ্যের শক্তিকে চিহ্নিত করতে হবে

রোহিঙ্গা নেতা খুন উদ্বেগজনক

রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ খুনের ঘটনা কেবল একজন ব্যক্তি মানুষকে নিঃশেষ করে দেওয়ার বিষয় হিসেবে বিবেচনার সুযোগ নেই। বুধবার রাত সাড়ে আটটার দিকে কক্সবাজারের উখিয়ায় লম্বাশিরা রোহিঙ্গা শিবিরে একদল সন্ত্রাসী তাঁকে হত্যা করে পালিয়ে যায়। ঘটনাটি খুবই উদ্বেগজনক। আমরা এই রোহিঙ্গা নেতার হত্যার কঠোর নিন্দা জানাই।

মুহিবুল্লাহ ছিলেন আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের চেয়ারম্যান। ২০১৭ সালে অন্যান্য শরণার্থীর সঙ্গে নিজ দেশ মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত হয়ে বাংলাদেশে আসার পর থেকে তিনি রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যাটি বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে তুলে ধরতে সচেষ্ট হন। তিনি জেনেভায় জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ও মিয়ানমারে গণহত্যার বিচার দাবি করেছেন। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তিনি রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে তাঁর সহায়তা কামনা করেছিলেন রোহিঙ্গাদের এই জনপ্রিয় নেতা। তাঁর হত্যাকাণ্ডের পেছনে ষড়যন্ত্রমূলক কিছু রয়েছে—এমন ধরে নেওয়া অস্বাভাবিক নয়।

এ রকম একজন নেতার খুন হওয়ার ঘটনায় নিশ্চিতভাবেই রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন দাবির আন্দোলন বাধাগ্রস্ত হবে। বিভিন্ন তথ্যের ভিত্তিতে এটা ধারণা করা হয় যে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মধ্যে দুটি ধারা সক্রিয় রয়েছে। এক পক্ষ ন্যূনতম দাবি আদায় করে মিয়ানমারে ফিরে যেতে আগ্রহী। আরেক পক্ষ মনে করে, মিয়ানমার কখনো রোহিঙ্গাদের দাবি মেনে নেবে না, তাই এখানে থেকে যাওয়াই ভালো। দ্বিতীয় পক্ষ চরমপন্থী হিসেবে পরিচিত। মুহিবুল্লাহ শুরু থেকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের পক্ষে জোর প্রচার চালিয়ে আসছিলেন। সে ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত বিরোধের কারণে তাঁকে হত্যা করা হয়েছে—এমন ধরে নেওয়া কঠিন।

দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংগঠনগুলোও রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহর হত্যার নিন্দা জানিয়েছে এবং মন্তব্য করেছে যে এতে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দেশে প্রত্যাবর্তন আরও কঠিন হয়ে পড়ল। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের দক্ষিণ এশীয় পরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলি বলেছেন, মুহিবুল্লাহ বরাবর রোহিঙ্গাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও মর্যাদার সঙ্গে দেশে ফিরে যাওয়ার পক্ষে জনমত তৈরি করেছেন। এই হত্যা রোহিঙ্গাদের অধিকারের পক্ষে ও সহিংসতার বিরুদ্ধে কথা বলা আরও ঝুঁকিতে ফেলে দিল।

প্রথম আলোর খবর থেকে জানা যায়, কয়েক দিন আগে থেকেই অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিরা তাঁকে খুন করার হুমকি দিয়ে আসছিল। এখানে প্রশ্ন আসে, সেই হুমকির বিষয়টি তিনি প্রশাসনকে জানিয়েছিলেন কি না। যদি জানিয়ে থাকেন, তাহলে তাঁর উপযুক্ত নিরাপত্তা দেওয়া উচিত ছিল। রোহিঙ্গা শরণার্থীশিবির একটি সংবেদনশীল অঞ্চল, বোঝা যায় সেখানকার নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ঘাটতি রয়েছে। এ ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে সেখানে সক্রিয় বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন কেন এ ব্যাপারে আগাম কোনো আঁচ-অনুমান করতে পারল না? এর আগেও রোহিঙ্গা শরণার্থীশিবিরে বেশ কিছু খুনের ঘটনা ঘটেছে, যার কারণ হিসেবে মাদক বা ইয়াবা ব্যবসা নিয়ে বিরোধের কথা বলা হয়। কিন্তু রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রধান নেতা কেবল মাদক ও ইয়াবা ব্যবসার কারণে খুন হননি, তা নিশ্চিত করে বলা যায়।

এখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তথা সরকারের দায়িত্ব মুহিবুল্লাহকে যারা খুন করেছে, তাদের খুঁজে বের করা এবং নেপথ্যে কারা রয়েছে, সেই বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া। এর সঙ্গে দেশের নিরাপত্তার প্রশ্ন জড়িত। মুহিবুল্লাহ হত্যার ঘটনা প্রমাণ করে রোহিঙ্গা শরণার্থীশিবিরের নিরাপত্তা কতটা ভঙ্গুর। মুহিবুল্লাহর হত্যারহস্য উন্মোচনের পাশাপাশি রোহিঙ্গা শরণার্থীশিবিরের নিরাপত্তা জোরদারের প্রয়োজনীয় সব উদ্যোগ নিতে হবে।