এইচএসসি পরীক্ষার ফল

রেকর্ড ভালো ফলের মধ্যে আছে শঙ্কা

সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়

গত রোববার প্রকাশিত হয়েছে উচ্চমাধ্যমিক সার্টিফিকেট (এইচএসসি) পরীক্ষার ফল। করোনা পরিস্থিতির কারণে আগেরবার সবাইকে অটো পাস দেওয়া হলেও এবার বিশেষভাবে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়, তা–ও নির্দিষ্ট সময়ের আট মাস পর। পাবলিক পরীক্ষাগুলোর যে জট লেগে গেছে এবং শিক্ষার্থীরা এর চরম ভুক্তভোগী হচ্ছেন, এ ব্যাপারে সরকারের নীতিনির্ধারণ নিয়ে নানা সমালোচনা ছিল। মহামারি পরিস্থিতিতে শিক্ষা কার্যক্রম কীভাবে চলবে, কত দ্রুত পুষিয়ে নেওয়া যাবে, তা নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েই গেছে। কারণ, এখনো আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে আছে। এবারও পরীক্ষা হওয়া না হওয়া নিয়ে দোলাচলের প্রভাব ছিল শিক্ষার্থীদের প্রস্তুতিতে। তবে পরীক্ষা শেষ হওয়ার প্রায় দেড় মাস পর প্রকাশ করা ফলাফলে দেখা গেল, পাসের হার এবং জিপিএ-৫ উভয় ক্ষেত্রেই শিক্ষার্থীরা বিগত অন্তত এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভালো করেছেন।

৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডে গড় পাসের হার ৯৫ দশমিক ৫৭ শতাংশ। এবার জিপিএ-৫ পেয়েছেন ১ লাখ ৭৮ হাজার ৫২২ জন, যা মোট পরীক্ষার্থীর ১৬ শতাংশ। পরীক্ষা ছাড়াই প্রকাশিত ২০২০ সালের এইচএসসি পরীক্ষার চেয়েও এবার জিপিএ-৫ বেশি। আর স্বাভাবিক সময়ে সব বিষয়ে অনুষ্ঠিত ২০১৯ সালের পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছিলেন ৪১ হাজার ৮০৭ জন, যা ওই বছরের মোট পরীক্ষার্থীর মাত্র ৩ দশমিক ৭১ শতাংশ। এই রেকর্ড ভালো ফলাফলের কারণ, সংক্ষিপ্ত পাঠ্যসূচিতে শুধু বিভাগভিত্তিক তিনটি নৈর্বাচনিক বিষয়ে ছয়টি পত্রে পরীক্ষা নেওয়া। প্রশ্নপত্রেও বেশি প্রশ্ন থেকে কম প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সুযোগ ছিল। পাশাপাশি অন্য বিষয়গুলো জেএসসি ও এসএসসি এবং সমমানের পরীক্ষার ফলের ভিত্তিতে ‘বিষয় ম্যাপিং’ করে ফল তৈরি করা হয়েছে। এতে যাঁরা জেএসসি ও এসএসসিতে ভালো করেছিলেন, তাঁদের অনেকেই ভালো করেছেন। আগে সাধারণত দেখা যেত, মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থীদের অনেকে ‘ইংরেজি’র মতো বিষয়ে ভালো করতেন না। এবার তাঁদের ইংরেজি বিষয়ে পরীক্ষা দিতে হয়নি।

দেশের পাবলিক পরীক্ষায় পাসের হারের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে আগে থেকেই সমালোচনা আছে। এবার সেই ঊর্ধ্বগতির রেকর্ড হলো। ফলাফলের তুলনায় শিক্ষার মান কতটা এগিয়েছে, এ নিয়ে নানা আশঙ্কার কথা হয়তো প্রতিবারের মতো এবারও আমরা শুনব শিক্ষাবিদ ও গবেষকদের কাছ থেকে। জিপিএ-৫–এর এ ‘বাম্পার ফলন’ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিতে শিক্ষার্থীদের জন্য অবশ্যই বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। আমরা দেখেছি, দেশের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ও মেডিকেল কলেজের প্রতিই বেশি ঝোঁক থাকে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের। সে ক্ষেত্রে তাঁদের প্রতি শিক্ষা–সংশ্লিষ্টদের পরামর্শ, গতানুগতিক ক্যারিয়ার পরিকল্পনা থেকে বের হয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য বিষয়বৈচিত্র্যের দিকে গুরুত্ব দিতে হবে।

এরপরও আরেকটি সমস্যা থেকেই যাবে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয়বারের মতো ভর্তি পরীক্ষার সুযোগ নেই। এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসনসংখ্যা কমানোর সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে গত বছর কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে যে জগাখিচুড়ি দশা হয়েছে, তা শিক্ষার্থীদের চরমভাবে ভুগিয়েছে। ভর্তি পরীক্ষাকেন্দ্রিক ভোগান্তি কমানোর চেয়ে বরং সেটি আরও বাড়িয়েই দিয়েছে। এবার অনেক শিক্ষার্থীকে ভরসা করতে হবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপর। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সেশনজট, কলেজগুলোতে পছন্দের বিষয় ও বিভাগের অনুপস্থিতি আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার আর্থিক সামর্থ্যহীনতার বিষয়টি জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের জন্য এক প্রকার অনিশ্চয়তার মধ্যেই ফেলবে বৈকি।

মেডিকেলে বিশেষ শর্ত যুক্ত করে দ্বিতীয়বার ভর্তি পরীক্ষার সুযোগ রাখা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও এমন কোনো পন্থা অবলম্বন করতে পারে। পাশাপাশি গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে গতবার যে অব্যবস্থাপনা দেখা গেছে, এবার তার পুনরাবৃত্তি রোধ করতে হবে। ভালো ফলাফলের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ উচ্চশিক্ষা ও ক্যারিয়ার নিয়ে শিক্ষার্থীরা যে স্বপ্ন দেখছেন, তা বাস্তবায়নের পথে শিক্ষার্থীরা যেন হোঁচট না খান।