আরও একটি দুর্ঘটনার অপেক্ষা?

রাসায়নিক গুদাম স্থানান্তর

সরকারের কথা ও কাজের মধ্যে যে বিস্তর ফারাক, পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিক গুদাম ও কারখানা সরিয়ে ফেলার উদ্যোগটি দীর্ঘদিন ঝুলে থাকা তার প্রমাণ। বলার অপেক্ষা রাখে না যে পুরান ঢাকার মানুষ একধরনের রাসায়নিক চুল্লির ওপর বসবাস করছে। কিন্তু ২০১০ সালে নিমতলীর অগ্নিকাণ্ডে ১২৪ জন মানুষের মৃত্যুর আগপর্যন্ত কর্তৃপক্ষ কুম্ভকর্ণের ঘুমে আচ্ছন্ন ছিল। সেই ভয়াবহ দুর্ঘটনার পর সরকার প্রথমে পুরান ঢাকা থেকে সব রাসায়নিক গুদাম ও কারখানা সরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নেয়। তখন ঠিক হয়েছিল কেরানীগঞ্জে রাসায়নিক শিল্পনগরী প্রতিষ্ঠা করা হবে। কিন্তু সেখানে প্রয়োজনীয় জমি না পাওয়ায় সরকার মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলার তিনটি মৌজায় রাসায়নিক শিল্পনগরী করার সিদ্ধান্ত নেয়। পুরান ঢাকার রাসায়নিক গুদাম ও কারখানাগুলোর স্থান হবে সেখানে। প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ১ হাজার ৬৪৯ কোটি টাকা এবং ২০২২ সালের জুনের মধ্যে বাস্তবায়ন করার কথা। পরিতাপের বিষয়, এখনো সেখানে জমি অধিগ্রহণের কাজই শুরু হয়নি। ইতিমধ্যে দুজন শিল্পমন্ত্রী বিদায় নিয়েছেন। তৃতীয়জন দায়িত্ব নিয়েছেন তাও আট মাস হলো।

চলতি বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি চকবাজারের চুড়িহাট্টায় আরেকটি রাসায়নিক গুদামে আগুন লেগে ৭১ জন মারা যায়। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও সিটি করপোরেশন নড়েচড়ে বসে। অবৈধ রাসায়নিক গুদামগুলোর বিরুদ্ধে সিটি করপোরেশনের নেতৃত্বে গঠিত টাস্কফোর্স কিছু কিছু পদক্ষেপও নেয়। শিল্পনগরী প্রতিষ্ঠা সময়সাপেক্ষ। এ কারণে সরকার অস্থায়ীভাবে রাসায়নিক গুদামগুলো সরিয়ে নিতে ১৬৮ কোটি টাকা ব্যয়ে দুটি প্রকল্প হাতে নেয়। এর একটি টঙ্গীর কাঁঠালদিয়া মৌজায়। অপরটি শ্যামপুরের বন্ধ হয়ে যাওয়া উজালা ম্যাচ ফ্যাক্টরির জায়গায়। কিন্তু এর কোনোটি গত আট মাসে অবৈধ দখলদারদের কাছ থেকে মুক্ত করা যায়নি। টঙ্গীতে ৪৫০টি পরিবার বাস করছে আর উজালা ম্যাচ ফ্যাক্টরির জায়গায় রয়েছে অবৈধ বাসস্ট্যান্ড। ফলে অস্থায়ী প্রকল্পের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত।

এ ছাড়া এই প্রকল্পের যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। যেখানে সরকার সিরাজদিখানে নতুন রাসায়নিক শিল্পনগরী প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা নিয়েছে, সেখানে মোটা অঙ্কের টাকা ব্যয়ে অস্থায়ীভাবে গুদাম সরানো হলে নতুন জটিলতা দেখা দিতে পারে। এসব ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের পুরান ঢাকা থেকে একবার কোথাও সরিয়ে নেওয়া হলে দ্বিতীয়বার তাঁদের স্থানান্তর করা সহজ হবে না। এতে ব্যবসায়ীরা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, তেমনি সরকারের অপচয়ও বাড়বে।

রাসায়নিক গুদাম ও কারখানা সরাতে কত বছর সময় লাগতে পারে? আমরা যদি ২০১০ সালকে ভিত্তিবছর ধরে নিই, তাহলে ইতিমধ্যে ৯ বছর কেটে গেছে। এ কারণে ভুক্তভোগীদের মধ্যে শঙ্কা জেগেছে, এসব অবৈধ রাসায়নিক গুদাম ও কারখানা সরাতে কি পুরান ঢাকাবাসীকে আরেকটি বড় দুর্ঘটনার জন্য অপেক্ষা করতে হবে? এ ছাড়া পরিবেশদূষণ ও স্বাস্থ্যঝুঁকি তো আছেই। সরকারের বিভিন্ন সংস্থা বলছে, গুদামগুলো সরানোর চেষ্টা চলছে। কিন্তু কেমিক্যাল অ্যান্ড পারফিউমারি মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের দাবি, অস্থায়ী গুদামে যাওয়ার জন্য চুক্তির বিষয়ে কেউ তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করেনি।

২০ ফেব্রুয়ারি চুড়িহাট্টার দুর্ঘটনার পর পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিক গুদাম অপসারণে টাস্কফোর্স যে অভিযান চালিয়েছিল, তা–ও এখন থমকে গেছে। সবকিছু আগের মতো চলছে। সিটি করপোরেশন যেসব গুদাম বন্ধ করে দিয়েছিল, সেগুলো আবার চালু করা হয়েছে। নিমতলী ট্র্যাজেডির পরও একই ঘটনা ঘটেছিল। টাস্কফোর্সের কাজ অবৈধ গুদামগুলো চিহ্নিত করা। শিল্প মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব উচ্ছেদ হওয়া গুদাম ও কারখানামালিকদের বিকল্প জায়গার ব্যবস্থা করা। পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিক কারখানা সরানো নিয়ে নয় বছর ধরে যা হচ্ছে, তা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দক্ষতা ও সক্ষমতার বিষয়টিকে প্রশ্নের মুখে ফেলছে।