দীর্ঘদিন অযত্ন–অবহেলায় পড়ে থাকার পর দেশের দ্বিতীয় সমুদ্রবন্দর মোংলা যে সাম্প্রতিক কালে ঘুরে দাঁড়িয়েছে, এটি আমাদের জন্য একটি সুখবর। চট্টগ্রাম আমাদের প্রধান সমুদ্রবন্দর এবং সমুদ্রপথে আমদানি-রপ্তানির প্রায় ৯০ শতাংশই পরিবহন করা হয় এর মাধ্যমে। চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর চাপ বেড়ে যাওয়ার ফলে এর দক্ষতা কমে যাচ্ছে, পণ্য খালাসে সময় বেশি লাগছে। ১৭ কোটি মানুষের একটি দেশের জন্য মাত্র একটি সমুদ্রবন্দর যথেষ্ট নয়। তাই আমদানি–রপ্তানি বাণিজ্যের অনেক প্রতিষ্ঠানকে মোংলা বন্দরের দিকে ঝুঁকতে হচ্ছে।
এই প্রেক্ষাপটে মোংলা বন্দর পুরোপুরি ব্যবহারে নেপালের আগ্রহ উৎসাহব্যঞ্জক। গত বুধবার বাংলাদেশে নিযুক্ত নেপালের রাষ্ট্রদূত ধন বাহাদুর ওলি মোংলা বন্দর পরিদর্শন করে বলেছেন, এই বন্দর দিয়ে সড়কপথে বাণিজ্যিক পণ্য নেপালে আনা-নেওয়ার কাজ দ্রুতই শুরু হবে। মোংলা বন্দরের সক্ষমতা বাড়াতে যেসব প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, তিনি সেসবের প্রশংসা করেন। তিনি জানিয়েছেন, এ বিষয়ে ভারতের সঙ্গে নেপালের চুক্তি হয়েছে। গত এপ্রিল মাসে ভুটানের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরে সময়ও দেশটি মোংলা বন্দর ব্যবহার এবং সীমান্তে আরও তিনটি স্থলবন্দর চালুর বিষয়ে আগ্রহ দেখিয়েছে। তা ছাড়া বাংলাদেশ ভুটানকে তামাবিল, বাংলাবান্ধা ও নাকুগাঁও স্থলবন্দর ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে। গত বছর পরীক্ষামূলকভাবে একটি সারের চালান নিয়ে এসেছিল নেপালের কোম্পানি। স্থানীয় আমদানিকারক খুলনার দেশ ট্রেডিং করপোরেশনের অনুকূলে চীন থেকে প্রায় ২৫ হাজার ৩৫০ টন সার নিয়ে বৃহস্পতিবার মোংলা সমুদ্রবন্দরে ভিড়েছে বিদেশি বাণিজ্যিক জাহাজ ‘এমভি ঠেটো টোকজ’। বৃহস্পতিবার রাতের পালা থেকে জাহাজের সার খালাসপ্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে মোংলা বন্দর বাংলাদেশের পাশাপাশি নেপাল, ভারত ও ভুটানের পণ্য পরিবহনের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হতে পারে। নেপাল ও ভুটান এত দিন ভারতের সমুদ্রবন্দরই ব্যবহার করে আসছে। কিন্তু তাতে ওই দুটি দেশের পরিবহন ব্যয় অনেক বেড়ে যায়। ২০১৬ সালে মদেশীয় আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ভারত নেপালে পণ্য পরিবহন বন্ধ করে দিয়েছিল। উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা চুক্তির আওতায় বাংলাদেশ, ভারত, ভুটান ও নেপালের মধ্যে চারদেশীয় যানবাহন পরিবহন চুক্তি সই হলেও ভুটানের সংসদ এটি এখনো অনুমোদন করেনি পরিবেশের দোহাই দিয়ে। ভুটানের পরিবেশ সুরক্ষিত থাক, তা আমরাও চাই। তবে যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নের বিষয়টিও উপেক্ষা করা যাবে না।
নেপাল ও ভুটানের আমাদের মোংলা বন্দর ব্যবহার করার ক্ষেত্রে কিছু বিষয় মাথায় রাখতে হবে। অর্থনৈতিকভাবে আমাদের এবং তাদের লাভ হয় এমন পদক্ষেপ নিতে হবে; বন্দর ও সড়ক যোগাযোগব্যবস্থা এমন পর্যায়ে উন্নীত করতে হবে, যাতে অপেক্ষাকৃত কম সময়ে তাদের পণ্য গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে। মোংলা বন্দর উন্নয়ন হলে শুধু ওই দুটি দেশ নয়, ভারতের অনেক পণ্যও এই বন্দর দিয়ে আনা–নেওয়া লাভজনক হবে। এ ক্ষেত্রে ভারতের সক্রিয় সহযোগিতার প্রয়োজন হবে। ১৯৯৮ সালে বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর উদ্বোধন করা হয়েছিল, কিন্তু ভারত সহযোগিতা করেনি বলে তখন তা চালু করা যায়নি। ভারত যদি উত্তর-পূর্ব ভারতে তাদের পণ্য পরিবহনের জন্য ট্রানজিট বা ট্রানশিপমেন্ট সুবিধা পেতে পারে, একই সুবিধা কেন নেপাল ও ভুটানকে তারা দেবে না?
২০১৬-১৭ অর্থবছরে মোংলা বন্দরে রাজস্ব আহরণে প্রবৃদ্ধি ছিল ১৫ শতাংশ। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এ হার বেড়ে প্রায় ৫০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। এক বছরের ব্যবধানে বন্দরে কনটেইনারবাহী জাহাজ আগমনের সংখ্যা বেড়েছে আড়াই গুণ। ভারত, নেপাল ও ভুটান মোংলা বন্দরের ট্রানজিটের (বাংলাদেশের ভূখণ্ড) ব্যবহারের মাধ্যমে এ বন্দরে পণ্য খালাস-বোঝাইয়ের পরিমাণ অনেক বেড়ে যাবে। সে জন্য বন্দরের অবকাঠামো ও যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে হবে।