দেশের নানা ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে তার একটি প্রমাণ অননুমোদিত রেলক্রসিং। সাম্প্রতিক কালে অবৈধ রেলক্রসিংয়ে দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে গেছে। রেলসংশ্লিষ্ট যত প্রাণহানি (গত বছর প্রায় আড়াই শ দুর্ঘটনায় ঝরল প্রায় আড়াই শ প্রাণ), তার ৮৯ শতাংশের উৎস লেভেল ক্রসিং। অথচ রেলওয়ের প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকার প্রকল্পে মাত্র এক শ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে লেভেল ক্রসিং খাতে। মানুষের মৃত্যুরোধের মতো বিষয়টিতে যে অগ্রাধিকার দরকার, তা সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকদের মাথায় নেই। এই না বোঝাটা কর্তব্যে গাফিলতি, আর তা চূড়ান্ত বিচারে ফৌজদারি অপরাধ। লেভেল ক্রসিংয়ের মৃত্যুগুলো সেই বিবেচনায় হত্যাকাণ্ড।
আসলে আমরা কতটা হতভাগ্য, সেটা গত মঙ্গলবার রেলমন্ত্রীর একটি প্রশ্নের মধ্যেই মূর্ত। তিনি প্রশ্ন রেখেছেন, কিন্তু তাঁর প্রশ্নের মধ্যেই সবটুকু উত্তর নিহিত আছে। রেলমন্ত্রী প্রশ্ন রেখেছেন, অবৈধ লেভেল ক্রসিং যেহেতু রেলওয়ে করেনি, তাই সেখানে কোনো দুর্ঘটনায় কারও প্রাণ গেলে তার দায় রেল কেন নেবে? অবশ্য বৈধ লেভেল ক্রসিংয়ে মৃত্যুর দায় এ পর্যন্ত রেল নিয়েছে বলেও আমাদের জানা নেই। রেলমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলন থেকে আমরা কিছু স্বীকারোক্তি পাই।
এক. ট্রেন যাতায়াতে সরকারি সংস্থাগুলোই বাধা সৃষ্টি করেছে। রেল কখনো মামলা করে বটে, কিন্তু সরকারি সংস্থা বলেই বেশি দূর যেতে পারেন না। দুই. কম বাজেটে বেআইনি লেভেল ক্রসিং চলমান রাখাটাই যে একটা ভয়ংকর ফৌজদারি অপরাধ, সে বিষয়টি জেনেও রেলের নিশ্চুপ থাকা। তিন. রেলপথ ব্যবস্থাপনায় সরকারি বিভাগ ও সংস্থাগুলোর মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই। চার. রেলমন্ত্রী প্রকারান্তরে নিশ্চিত করেছেন যে রেলপথে নিরাপত্তা বলে কিছু নেই। তাঁরই দেওয়া তথ্য, সারা দেশের ৩ হাজার ২০০ লেভেল ক্রসিংয়ের মধ্যে প্রায় ২ হাজার লেভেল ক্রসিং অবৈধ।
উল্লিখিত বাস্তবতা বিবেচনায় নিলে দেশের রেল ও সড়কপথের যাত্রীরাই শুধু নয়, পথচারীরা আতঙ্কিত বোধ করবেন। অবৈধ ও প্রহরীবিহীন প্রতিটি লেভেল ক্রসিং বাংলাদেশের যোগাযোগ নেটওয়ার্ক এবং সংশ্লিষ্ট জনপদগুলোর জন্য মৃত্যুফাঁদের মতো। ট্রেন বা বাসের যাত্রী না হয়েও শুধু লেভেল ক্রসিংয়ের কাছাকাছি বসবাস বা চলাচলের জন্য যেকোনো মানুষের জীবনে নেমে আসতে পারে বিভীষিকা।
আমরা রেলমন্ত্রীকে ধন্যবাদ দেব যে তাঁরা মানবতার ডাকে সাড়া দিয়ে বিলম্বে হলেও যে রেল ভবনে একটি সংবাদ সম্মেলনে মুখোমুখি হয়েছেন এবং অপ্রিয় সত্য তুলে ধরেছেন। কিন্তু লেভেল ক্রসিং বিষয়ে অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার যে চিত্র তিনি এখন তুলে ধরেছেন, তা অনেক আগেই শুধরে ফেলা ছিল তাঁরই কর্তব্য। সুতরাং ব্যর্থতার দায় রেল মন্ত্রণালয়কেই নিতে হবে।
উপরন্তু রেলমন্ত্রীর কাছে আমরা একটি আশু ব্যাখ্যা আশা করব, সেটা হলো রেল কর্তৃপক্ষের তৈরি করা একটি সাম্প্রতিক প্রতিবেদন। যাতে বলা হয়েছে, ১ হাজার ৪৪২টি অনুমোদিত লেভেল ক্রসিংয়ে মাত্র ৪৬৬টির গেটে গেটম্যান রয়েছে। তাহলে বাকিগুলো কারা কীভাবে চালাচ্ছে কিংবা আদৌ সেখানে কোনো ব্যবস্থাপনা আছে কি না। যদি লোকবল না দিতে পারার কারণ অর্থসংকট বলা হয়, তাহলে সেটা হবে মেগা উন্নয়ন প্রকল্পের দাবিদার সরকারের জন্য অগৌরবের।
রেলের ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে এই চরম বিশৃঙ্খলার জন্য এর সঙ্গে যুক্তদের জবাবদিহিতে বাধ্য করা দরকার। রেলমন্ত্রী নিজেই বলেছিলেন, কুলাউড়ার দুর্ঘটনা ‘আমরা সতর্ক’ হলে এড়ানো যেত। যাদের সতর্কতার অভাবে দুর্ঘটনা ঘটে, তাদের শাস্তি দিতে না পারলে রেলওয়ের বিশৃঙ্খলা কাটবে না।