স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী কিংবা বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে যেকোনো রাষ্ট্রীয় আয়োজন জাতির জন্য আনন্দের বিষয়। দক্ষিণ এশিয়ার পাঁচটি দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানের উপস্থিতি এ আয়োজনকে আরও মহিমান্বিত করেছে। কিন্তু সুবর্ণজয়ন্তীর সেই মহত্তম ঘটনাটি আর আনন্দময় থাকেনি।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকায় আসার বিরোধিতা করে আসছিল কয়েকটি সংগঠন, যার মধ্যে হেফাজতে ইসলাম নামের একটি অরাজনৈতিক সংগঠনও ছিল। হেফাজতে ইসলাম ও কয়েকটি বাম সংগঠন আগে থেকেই প্রতিবাদ কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল। সরকারের নীতিনির্ধারকেরা হয় পরিস্থিতির ভয়াবহতা আঁচ করতে পারেননি অথবা আঁচ করলেও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে যারপরনাই ব্যর্থ হয়েছেন। হেফাজতের প্রতিবাদকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে সহিংসতা হয়েছে এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর ও এর আশপাশের এলাকায় দুই দিন ধরে হেফাজতের সমর্থকেরা তাণ্ডব চালিয়েছেন। তঁাদের আক্রমণ থেকে রেহাই পায়নি সরকারি অফিস, থানা, রেলস্টেশন, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ভাষা চত্বর, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সংগীত একাডেমিও। হাটহাজারী ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সহিংসতায় প্রাণ গেছে ১৬ জনের।
স্থানীয় প্রশাসন ও সরকারের নীতিনির্ধারকেরা কেন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হলেন, সেই প্রশ্ন উঠেছে। যেখানে প্রেসক্লাবের সামনে বিরোধী দল বিএনপির দেড় শ লোকের সমাবেশ ঘিরে ১০০ পুলিশ মোতায়েন করা হয়, রাস্তায় বিনা অনুমতিতে একটি মিছিল বের করলে সর্বশক্তি নিয়ে তা ছত্রভঙ্গ করা হয়, সেখানে হেফাজতের ক্ষেত্রে তা সম্ভব হলো না কেন?
হেফাজতে ইসলামের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ব্রাহ্মণবাড়িয়া কিংবা হাটহাজারীতে তাদের পূর্বঘোষিত কোনো কর্মসূচি ছিল না। ঢাকায় বায়তুল মোকাররম মসজিদের উত্তর গেটে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ কর্মসূচিতে হামলার পরই ওই দুটি স্থানে স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ হয়। প্রতিবাদ স্বতঃস্ফূর্ত হোক আর সংগঠিত হোক, জানমাল রক্ষার দায়িত্ব সরকারের। কিন্তু ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও হাটহাজারীতে সেটি রক্ষা করতে তারা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। যেকোনো মৃত্যুই বেদনাদায়ক। যাঁরা কওমি মাদ্রাসার গরিব ছাত্রদের রাজনীতির ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করেন, তাঁদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে।
অন্যান্য ক্ষেত্রেও দেখা যায় সরকারের অত্যুৎসাহী লোকজন বিরোধী পক্ষকে ঠেকাতে প্রশাসনিক পদক্ষেপের বাইরে দলীয় কর্মীদের নিয়োগ করে থাকেন। এবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি। গত শুক্রবার বায়তুল মোকাররমে প্রতিবাদকারীদের মোকাবিলায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের পাশাপাশি ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের কর্মীদেরও দেখা গেছে। সরকার প্রতিবাদকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিলে তাঁদের ওপর হামলাকারীরা কেন ছাড় পাবেন? আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার এখতিয়ার কি কারও আছে? গণতান্ত্রিক সমাজে শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক সভা-সমাবেশ করার অধিকার প্রত্যেকের আছে। সরকারকে বুঝতে হবে যে যখন মানুষের প্রতিবাদের ভাষা রুদ্ধ হয়, তখন এ ধরনের বিশৃঙ্খল ও সহিংস পরিস্থিতি তৈরি হওয়া অস্বাভাবিক নয়।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঘটনার কয়েক দিন কেটে গেলেও মৃত্যুর ঘটনায় মামলা হয়নি। ভাঙচুরের ঘটনায় মামলা হলেও আসামি করা হয়েছে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের। সরকার একদিকে বলছে হেফাজতের নেতৃত্ব এই তাণ্ডব ঘটিয়েছেন। অন্যদিকে ঢাকার বাইরে হেফাজত নেতাদের নামে কোনো মামলাই হয়নি। পুলিশপ্রধান বেনজীর আহমেদ বলেছেন, মামলায় হেফাজতের নেতাদের নাম না থাকলেও তদন্তে বেরিয়ে আসবে। নির্মম সত্য হলো, অন্যান্য ক্ষেত্রে সরকারের কাছে এ সহিষ্ণু মনোভাব দেখা যায় না। তাহলে কি সরকার এখনো আইন ভঙ্গকারীদের বিচারের চেয়ে রাজনৈতিক বিচারকেই অধিক গুরুত্ব দিচ্ছে? আইন সবার ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রয়োগ হতে হবে। সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। অন্যথায় মামলা-গ্রেপ্তার তথা হেফাজত সম্পর্কে সরকারের অবস্থান নিয়ে ধোঁয়াশা থেকেই যাবে।