মানবসম্পদ উন্নয়নে অগ্রগতি

বিশ্বব্যাংকের ২০১৮ সালের মানবসম্পদ সূচকে বাংলাদেশের মানবসম্পদ উন্নয়নের যে চিত্র তুলে ধরা হয়েছে, তা উৎসাহব্যঞ্জক। সংস্থাটির মতে, 

ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে আছে।

পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যুর হার, শিশুদের স্কুলে পাঠ গ্রহণের সময়কাল, শিক্ষার মান, প্রাপ্তবয়স্কদের অন্তত ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত বেঁচে থাকা এবং শিশুদের সঠিক আকারে বেড়ে ওঠাসহ কয়েকটি সূচক দিয়ে এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। আদর্শ শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসুবিধা পেলে একটি শিশু প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে শতভাগ উৎপাদনশীলতা দেখাতে পারে। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের শিশুদের সম্ভাব্য উৎপাদনশীলতা ৪৮ শতাংশ। এর অর্থ বাংলাদেশের শিশুরা উৎপাদনশীলতায় এখনো ৫২ শতাংশ পিছিয়ে আছে।

এর আগে গত সেপ্টেম্বরে ইউএনডিপির প্রতিবেদনে মানবসম্পদ উন্নয়নে বাংলাদেশ তিন ধাপ এগিয়েছে বলে জানানো হয়। ১৮৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩৬তম। এ ক্ষেত্রেও পাকিস্তান বাংলাদেশ থেকে পিছিয়ে আছে। অন্যদিকে দুই প্রতিবেদনেই শ্রীলঙ্কা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষ অবস্থানে আছে। সেখানে শিক্ষার হার ও স্বাস্থ্যসেবার মান বৃদ্ধির কারণেই এটি সম্ভব হয়েছে।

বাংলাদেশ সরকারও এক দশক ধরে মানবসম্পদ উন্নয়নের ওপর বেশ জোর দিয়েছে বলে পরিকল্পনা কমিশনের একজন সদস্য প্রথম আলোকে জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, জিডিপির ৩ থেকে ৪ শতাংশ শিক্ষা খাতে এবং ২ শতাংশ স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু যেসব দেশ দ্রুত উন্নয়ন করেছে, সেসব দেশে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় বরাদ্দের হার এর চেয়ে অনেক বেশি। সে ক্ষেত্রে আমাদের মানবসম্পদ উন্নয়ন তথা শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবায় আরও বেশি বরাদ্দ করতে হবে। আর শুধু বরাদ্দ করাই যথেষ্ট নয়। সেই বরাদ্দ কীভাবে ব্যয় হচ্ছে, সে বিষয়েও নিবিড় তদারকি প্রয়োজন। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত একবার বলেছিলেন, দুর্নীতি কমাতে পারলে ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি বাড়ানো সম্ভব।

নোবেল বিজয়ী বাঙালি অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনও বাংলাদেশের মানবসম্পদ উন্নয়নের ভূয়সী প্রশংসা করে থাকেন। বিশেষ করে নারীশিক্ষার উন্নয়নে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে আদর্শ বলে তিনি অভিহিত করেছেন। বাংলাদেশ নবজাতক ও শিশুমৃত্যুর হার কমাতে অনেকটা সফল হলেও বিদ্যালয়ে ঝরে পড়ার হার তুলনামূলক বেশি। এটি শূন্যে নিয়ে আসতে হবে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন হলেও তার সুবিধা পাচ্ছেন মুষ্টিমেয় মানুষ। দারিদ্র্যের হার কমানোর গতিও মন্থর।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন থেকেই জানা গেল, আমাদের শিশুমৃত্যুর হার কমলেও এখনো সব শিশুকে পুষ্টিকর খাবার দেওয়া যাচ্ছে না। ফলে তাদের অনেকেই খর্বাকৃতি নিয়ে বড় হচ্ছে। মানবসম্পদের সব সূচকে শ্রীলঙ্কা অনেক আগে থেকেই এগিয়ে ছিল। কিন্তু এবার নেপালের ১০২তম স্থানে আসা ঈর্ষণীয় সাফল্য বলেই মনে করি। তাদের শিশুদের উৎপাদনশীলতা ৪৯ শতাংশ, আমাদের চেয়ে এক ভাগ বেশি। অন্যদিকে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর তুলনায় ভালো অবস্থানে থাকলেও পৃথিবীর অন্যান্য দেশ থেকে অনেক পিছিয়ে আছে। এশিয়ারই আরেকটি দেশ সিঙ্গাপুরের শিশুদের উৎপাদনশীলতা ৮৮ শতাংশ। এরপর দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে রয়েছে।

বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ও গড় আয় বেড়েছে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবাতেও যে আমরা মোটামুটি সাফল্য অর্জন করেছি, বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনই তার প্রমাণ। কিন্তু এখানেই থেমে থাকলে চলবে না। আমাদের যেতে হবে আরও বহুদূর। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের এই সফলতার সঙ্গে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়াতে পারলে উন্নয়নের গতি যেমন বাড়বে, মানবসম্পদ উন্নয়নেও আমরা উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিতে পারব।