গত বুধবার ঢাকার বাংলামোটরের এক বাসা থেকে পুলিশ নুরুজ্জামান কাজল নামের যে ব্যক্তিকে আটক করেছে, তাঁর সম্পর্কে সংবাদপত্রে প্রকাশিত বর্ণনা থেকে অনুমান হয়, তিনি গুরুতর মানসিক সমস্যার শিকার। আটকের সময় তাঁর হাতে ছিল একটা দা। সে সময় ওই বাসায় তাঁর চার বছর বয়সী শিশুসন্তান ছাড়া আর কেউ ছিল না। ওই এলাকার যেসব কৌতূহলী লোক রাস্তায় ভিড় করে তাঁকে দেখছিল, তাদের আশঙ্কা হয়েছিল, তিনি হয়তো নিজের ছেলেটিকে খুন করতে যাচ্ছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বেশ বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে তাঁকে আটক করেছেন, নইলে কী মর্মান্তিক ঘটনা ঘটতে পারত আমরা জানি না।
অবশ্য ওই বাসায় অত্যন্ত মর্মান্তিক একটা ঘটনা ইতিমধ্যে ঘটেই গেছে। পুলিশ নুরুজ্জামানকে আটক করার সময় সেখানে এক শিশুর লাশও পেয়েছে। এই শিশুও তাঁর ছেলে, বয়স মাত্র আড়াই বছর। সম্ভবত তাকে হত্যা করা হয়নি। কিন্তু তার পুষ্টিহীনতা ও অন্যান্য শারীরিক আলামত থেকে ধারণা করা হচ্ছে, শিশুটি দিনের পর দিন প্রয়োজনীয় খাবার পায়নি। অথচ পরিবারটি দরিদ্র নয় যে খাবারের সংকটে শিশুদের দিনের পর দিন অনাহারে কাটাতে হবে।
আসলে পরিবারটি এক বিরাট নৈরাজ্যের মধ্যে পড়েছে, যার কারণ মাদকদ্রব্য। নুরুজ্জামানের পরিবারের ভাষ্য অনুযায়ী, তিনি মাদকাসক্ত। তাঁর মনস্তাত্ত্বিক বিপর্যয় ও বিপজ্জনক মাত্রার উন্মাদনার পেছনে রয়েছে তাঁর মাদকাসক্তি। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে তাঁর হিংস্র আচরণের দু–একটি
দৃষ্টান্তের কথা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। তিনি তাঁর স্ত্রীকে পিটিয়ে বাসা থেকে বের করে দিয়েছেন, কিন্তু শিশুসন্তানদের তাদের মায়ের সঙ্গে যেতে দেননি। মায়ের অভাব পূরণ করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। প্রতি বেলায় দোকান থেকে খাবার কিনে এনে ছোট ছোট শিশুদের খাওয়াতেন বলে তঁার আত্মীয়স্বজন সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন। কিন্তু তিনি যে মানসিকভাবে অসুস্থ, তাঁর পক্ষে যে স্বাভাবিকভাবে সন্তান লালন-পালন করা সম্ভব নয়, শেষ পর্যন্ত তিনি তা প্রমাণ করেছেন। তাঁর মাদকাসক্তির কারণে তাঁর সংসার লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। তাঁর শিশুসন্তানটিকে তিনি নিজের হাতে হত্যা করেননি বটে, তবে মাত্র আড়াই বছর বয়সে তার এই করুণ মৃত্যুর দায় শেষ পর্যন্ত তাঁর ওপরই বর্তায়।
নুরুজ্জামানের বিরুদ্ধে তাঁর স্ত্রী হত্যা মামলা দায়ের করেছেন, পুলিশ তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডে নিয়েছে। আইনানুগ পন্থা অবলম্বন করা
অবশ্যই প্রয়োজন। তবে সম্ভবত সেটাই যথেষ্ট হবে না। নুরুজ্জামানের মানসিক স্বাস্থ্যও পরীক্ষা করা প্রয়োজন, প্রয়োজন তাঁর মাদকাসক্তি দূর করা এবং মানসিক স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের জন্য প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা।
সারা দেশে নুরুজ্জামানের মতো মাদকাসক্ত মানুষের সঠিক সংখ্যা কত আমরা জানি না। খোদ মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কাছেই মাদকাসক্তির সঠিক হিসাব নেই। কিন্তু আমাদের জানা আছে, মাদকাসক্তির কারণে সারা দেশের শহরে ও গ্রামে অনেক পরিবারে গুরুতর বিপর্যয় নেমে এসেছে। সন্তানের মাদকাসক্তির কারণে অনেক পরিবার ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, মাদকাসক্ত স্বামীর হাতে অনেক নারী খুন হচ্ছেন, অনেকে নিয়মিত নির্যাতিত হচ্ছেন। মাদকাসক্তির কারণে কিশোর, তরুণ ও যুবসমাজের বড় একটা অংশের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য বড় ধরনের ঝুঁকিতে পড়েছে। পারিবারিক অশান্তি ও সহিংসতা বৃদ্ধির একটা বড় কারণ মাদকাসক্তির বৃদ্ধি।
কিন্তু মাদকদ্রব্যের ব্যবসা ও সেবন বন্ধ করার সরকারি প্রচেষ্টা বারবার ব্যর্থ প্রমাণিত হচ্ছে। এসব ধারাবাহিক ব্যর্থতার কারণ নির্ণয় করা প্রয়োজন। ব্যর্থতার জন্য যাঁরা দায়ী, তাঁদের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। সমস্যাটি অত্যন্ত গুরুতর।