সাম্প্রতিক কিছু ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মাঠ প্রশাসনের নিরাপত্তা নিয়ে জনপ্রশাসনের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, তা অযৌক্তিক নয়। গত কয়েক দিনে বেশ কিছু স্থানে থানা-পুলিশ আক্রান্ত হয়েছে, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) অফিস ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। আক্রমণ করা হয়েছে রেলস্টেশনসহ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার অফিসে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের ভাষ্য অনুযায়ী, এসব ঘটনায় প্রায় ১০০ কোটি টাকার সম্পদ ধ্বংস হয়েছে।
২০১৪ সালে দশম সংসদ নির্বাচন ও ২০১৫ সালে বিএনপির লাগাতার অবরোধের পর এ রকম ধ্বংসাত্মক ঘটনা আর ঘটেনি। পুলিশপ্রধান বেনজীর আহমেদ মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের প্রয়োজনে অধিক ক্ষমতার অস্ত্র চালানোর নির্দেশ দিয়েছেন। মাঠপর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে এক ভার্চ্যুয়াল বৈঠকে তিনি বলেছেন, সহিংসতার ঘটনা কঠোরভাবে দমন করতে হবে। রাবার বুলেটে পরিস্থিতি দমন করা না গেলে প্রয়োজনে আরও কঠোর হওয়ার নির্দেশনাও দিয়েছেন আইজিপি। বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের নিরাপত্তায় নিয়োজিত আনসারদের সার্বক্ষণিক অস্ত্র ও গুলি সঙ্গে রাখার নির্দেশনা দিয়েছে।
যাঁরা সরকারের মাঠপর্যায়ে কাজ করেন, তাঁদের নিরাপত্তার বিষয়টি কোনোভাবে উপেক্ষা করা যায় না। সরকারি অফিস বা সম্পত্তি রক্ষা করতে কোনো প্রশাসনিক কর্মকর্তা কিংবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য আক্রান্ত হবেন, তা মেনে নেওয়া যায় না। এখন প্রশ্ন হলো, এর প্রতিকার কী। প্রথমত, রাজনৈতিক বা অরাজনৈতিক যা–ই হোক না কেন, কোনো কর্মসূচির নামে এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা যাতে না ঘটে, সে বিষয়ে স্থানীয় প্রশাসনকে সর্বোচ্চ সজাগ থাকতে হবে।
সাম্প্রতিক সময়ে যেসব অঘটন ঘটেছে, তার বেশির ভাগ হেফাজতে ইসলাম নামে একটি সংগঠনের কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসন আগাম কী ব্যবস্থা নিয়েছে, সেই প্রশ্নও না উঠে পারে না। তাঁরা হেফাজতে ইসলামের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে বলতে পারতেন, শান্তিপূর্ণ উপায়ে কর্মসূচি পালন করতে হবে, কোনো রকম সহিংসতা করা যাবে না। প্রয়োজনে তাঁরা সেই এলাকার জনপ্রতিনিধিদের নিয়েও বসতে পারতেন। মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা কীভাবে কাজ করবেন, ওপর থেকে তার নির্দেশনা থাকে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই দায়িত্বপ্রাপ্তদের পদক্ষেপ নিতে হয় নিজেদের বিচারবুদ্ধি খাটিয়ে। তাদের উদ্দেশ্য হতে হবে যথাসম্ভব কম ক্ষতি করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া। কিন্তু সাম্প্রতিক প্রায় প্রতিটি ঘটনায় রাষ্ট্র ও জনগণের সম্পদ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিপরীতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও হাটহাজারীতে ১৭ জন মানুষ মারা গেছেন, যাঁদের বেশির ভাগই সাধারণ মানুষ। নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ ও ফরিদপুরের সালথার ঘটনার উল্লেখ করে আইজিপি বলেছেন, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের আরও সতর্ক হওয়া উচিত ছিল।
আইজিপি প্রয়োজনে অধিক ক্ষমতার অস্ত্র ব্যবহার করার যে বার্তা দিয়েছেন, তাতে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। মাদক ও সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানে কথিত বন্দুকযুদ্ধে অধিক ক্ষমতার অস্ত্র ব্যবহারের অনেক নজির আমরা দেখেছি। এতে অপরাধ কমেনি, আইনশৃঙ্খলারও উন্নতি হয়নি। মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের নিরাপত্তার প্রধান উপাদান হলো জনগণের আস্থা অর্জন। সব সমস্যা আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা করা। মনে রাখতে হবে, প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তারা যখন সরকারি বিধি লঙ্ঘন করে কোনো দলের পক্ষে বা বিপক্ষে কাজ করেন তখন যেমন শৃঙ্খলা থাকে না, তেমনি প্রশাসনের প্রতি আস্থাও শূন্যে নেমে আসে।