সরকারকে দ্রুত তৎপর হতে হবে

ভূমধ্যসাগরে ৬৪ বাংলাদেশি

ভিয়েতনাম যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত প্রায় আট লাখ ভিয়েতনামি নাগরিক ডিঙি সম্বল করে ব্রিটেন, হংকং, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ডের উদ্দেশে রওনা হয়েছিলেন। তাঁদের সবার পক্ষে ঈপ্সিত গন্তব্যে পৌঁছা সম্ভব হয়নি। নৌকা উল্টে বহু লোকের সলিলসমাধি হয়েছিল। গত শতাব্দীতে ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’ করা সেই ভিয়েতনামিরা ইতিহাসের পাতায় ‘বোট-পিপল’ তকমা নিয়ে বেঁচে আছেন।

এই শতাব্দীতে মিয়ানমার থেকে নিরাপত্তার খোঁজে সাগরে ভেসে আসা রোহিঙ্গাদের ছবি এখনো সবার চোখে লেগে আছে। তবে এই ধরনের বেপরোয়া ‘অভিযাত্রা’ সবচেয়ে বেশি দেখা যাচ্ছে ভূমধ্যসাগর এলাকায়। বছর তিনেক আগে সিরিয়ার যুদ্ধ যখন তুঙ্গে, তখন ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপীয় সৈকতে ভেড়ার জন্য মরিয়া আরব ও উত্তর আফ্রিকার উদ্বাস্তুদের মাঝদরিয়ায় মারা পড়তে দেখা গেছে। এই উদ্বাস্তুরা প্রধানত গৃহযুদ্ধ-জর্জরিত সিরিয়া, ইরিত্রিয়া কিংবা সোমালিয়ার নাগরিক। অন্যরা লিবিয়া, আলজেরিয়া ও মিসরের।

উদ্বেগের বিষয় হলো সম্প্রতি ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবিতে মারা পড়া অথবা সেখান থেকে উদ্ধার হওয়া লোকজনের মধ্যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বাংলাদেশিকে দেখা যাচ্ছে। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, তিউনিসিয়ার উপকূলে ৬৪ জন বাংলাদেশিসহ ৭৫ অভিবাসনপ্রত্যাশীকে উদ্ধার করেছে মিসরের একটি নৌযান। এরপর ১২ দিন পেরিয়ে গেলেও উদ্ধারকারী নৌযানটি কূলে ভিড়তে পারছে না। তাঁরা এখনো সাগরে ভাসছেন, কারণ, তিউনিসিয়ার কর্তৃপক্ষ নৌযানটিকে তীরে ভেড়ার অনুমতি দিচ্ছে না।

এই অভিবাসনপ্রত্যাশীরা লিবিয়া থেকে ইউরোপ যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। জানা যাচ্ছে, সাগরে ভাসমান লোকজনের জন্য খাদ্য ও চিকিৎসা সহায়তা পাঠানো হলেও তাঁরা তা প্রত্যাখ্যান করে এর পরিবর্তে ইউরোপ যাওয়ার সুযোগ চেয়েছেন। রেড ক্রিসেন্ট বলছে, তাঁদের শারীরিক অবস্থা এখন বেশ খারাপ।

 গত মাসে এভাবে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়ার সময় তিউনিসিয়ার উপকূলে নৌকা ডুবে অর্ধশত বাংলাদেশির মৃত্যু হয়েছে। এরপর এত কম সময়ের ব্যবধানে আবার এত বেশি সংখ্যক বাংলাদেশির ‘ইউরোপ যাত্রার’ খবর সন্দেহাতীতভাবে উদ্বেগজনক। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশিদের এই ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’ ঠেকাতে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বা হচ্ছে, তা পরিষ্কার নয়। যে ৬৪ জন বাংলাদেশি উত্তাল দরিয়ায় আটকে আছেন, তাঁদের নিরাপত্তায় সরকারের দিক থেকে কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, তা দ্রুত জানানোর প্রত্যক্ষ দায় সরকারের ঘাড়ে বর্তায়।

এসব অভিবাসনপ্রত্যাশীর নিরাপত্তা বিবেচনার যে নৈতিক দায় সভ্যতার থাকে, তা মানবাধিকার সংস্থাগুলো নিয়ত স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। অথচ ইউরোপীয় দেশগুলোর মনোভাবটি হলো: কিছু লোককে আশ্রয় দিলে অন্যরাও উৎসাহিত হয়ে ডিঙি ভাসাবে। তার চেয়ে বরং কয়েকটি ডিঙি মাঝদরিয়ায় উল্টে যাক, তাতে অপেক্ষমাণ শরণার্থীরা সাগর পাড়ি দিতে নিরুৎসাহিত হবে।

এই সত্য অকূল দরিয়ায় ঝাঁপ দেওয়ার জন্য তৈরি হওয়া বাংলাদেশিদেরও অনুধাবন করা দরকার।