গত মঙ্গলবার সিলেট শহরতলির আখালিয়ায় অবস্থিত কুমারগাঁও এলাকায় কয়েকটি বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রে কাছাকাছি সময়ে যেসব অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে, তা থেকে কিছু প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। প্রথম প্রশ্নটি হলো, এই আধুনিক প্রযুক্তির যুগে আমাদের দেশে কেন এবং কীভাবে এত ঘন ঘন এ ধরনের অগ্নিকাণ্ড ঘটছে। এই প্রশ্নের কারণ, চলতি বছরেই এর আগে দেশের চারটি জেলায় পাঁচ দফায় বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রে অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে।
একেকটি অগ্নিকাণ্ড ঘটে আর বিপুলসংখ্যক বিদ্যুৎ ভোক্তা দুর্ভোগে পড়ে যান। মঙ্গলবার যে উপকেন্দ্রে অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে, তার মাধ্যমে সিলেট ও সুনামগঞ্জের প্রায় ৪ লাখ ৩২ লাখ গ্রাহক বিদ্যুৎ পেয়ে থাকেন। অগ্নিকাণ্ডের পর ওই দুটি জেলার বিস্তীর্ণ এলাকা বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়ে। ফলে প্রথমেই পানির জন্য হাহাকার পড়ে যায়; তারপর বিদ্যুতের অভাবে গৃহস্থালি, অফিস-আদালত, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও অন্যান্য স্থাপনায় স্বাভাবিক কাজকর্মের যে ছন্দপতন ঘটে, সেসব তো ছিলই। ওই অগ্নিকাণ্ডের পাঁচ-ছয় দিন পরও সিলেট ও সুনামগঞ্জের অনেক এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরেনি। ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের শিকার হচ্ছে জনসাধারণ। সুতরাং বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রে অগ্নিকাণ্ডে সৌভাগ্যক্রমে হতাহতের ঘটনা না ঘটলেও জনজীবনে এগুলোর নেতিবাচক প্রভাব নগণ্য নয়।
সিলেটের কুমারগাঁও এলাকায় বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড এবং বেসরকারি কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র ও উপকেন্দ্র। সেগুলোর একটি থেকে আরেকটির দূরত্ব খুবই কম। মঙ্গলবারের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাটি তদন্তের জন্য পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) নামের একটি বেসরকারি বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রের কর্তৃপক্ষ নিজে, সরকারের বিদ্যুৎ বিভাগ ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড পৃথকভাবে তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। সব কটি তদন্ত কমিটির সদস্যরা ঘটনাস্থল সরেজমিন পর্যবেক্ষণ করেছেন এবং দুটি তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন আজ জমা দেওয়ার কথা রয়েছে বলে সংবাদমাধ্যমে বলা হয়েছে।
অবশ্য ইতিমধ্যেই অগ্নিকাণ্ডের বিষয়ে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) নামের বেসরকারি মালিকানাধীন বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র, দেশ এনার্জি নামের একটি বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র এবং বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের তরফ থেকে ভিন্ন ভিন্ন ভাষ্য পাওয়া গেছে। পিজিসিবি কর্তৃপক্ষের গঠন করা তদন্ত কমিটির ভাষ্য হলো, অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়েছিল বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র ও উপকেন্দ্রের তার ছিঁড়ে শর্টসার্কিটের মাধ্যমে। আর বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের গঠন করা তদন্ত কমিটির ভাষ্য হলো, অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত ঘটেছিল দেশ এনার্জি নামের একটি বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র থেকে। দেশ এনার্জি কর্তৃপক্ষ এই ভাষ্য প্রত্যাখ্যান করে বলেছে, তাদের প্রতিষ্ঠানে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত ঘটেনি।
এই তিন কর্তৃপক্ষের এমন পরস্পরবিরোধী ভাষ্য থেকে কোথায় কীভাবে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়েছিল, তা নিশ্চিতভাবে ধরে নেওয়া সম্ভব নয়। এ জন্য প্রয়োজন বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি গঠন করা। বুয়েট বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের বিশেষজ্ঞদের সহযোগিতা নেওয়া যেতে পারে। যেভাবেই অগ্নিকাণ্ড ঘটে থাকুক না কেন, সাধারণভাবে যেসব অভিযোগ বারবার উচ্চারিত হচ্ছে, সেগুলোর প্রতিকার করার উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। প্রথমত, নিম্নমানের ও পুরোনো বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র ও উপকেন্দ্র চালানোর অভিযোগ সত্য হলে অবিলম্বে সেগুলো প্রতিস্থাপন করা উচিত।
দ্বিতীয়ত, সম্ভাব্য দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য আন্তর্জাতিকভাবে সুরক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে, সেগুলো নিশ্চিত করতে হবে। নিয়মিত নজরদারির অভাব, অসতর্কতা, দায়িত্ব পালনে অবহেলার কারণে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে; ঘন ঘন অগ্নিকাণ্ডের পেছনে এটাও একটা কারণ হয়ে থাকতে পারে। সুতরাং এ বিষয়ে দায়িত্বশীলতা ও সুব্যবস্থাপনা অবশ্যই প্রয়োজন। এ ধরনের অগ্নিকাণ্ডের জন্য ব্যক্তিপর্যায়ের দায়দায়িত্ব এড়ানোর সুযোগ নেই। বিদ্যুৎকেন্দ্র বা উপকেন্দ্রগুলোতে এ ধরনের অগ্নিকাণ্ডের পুনরাবৃত্তি এড়াতে তাদের জবাবদিহি নিশ্চিত করা একান্ত জরুরি।