দেশে বিদ্যালয় এখন কেবল নির্জলা শিক্ষাদানের কেন্দ্র নয়। শিক্ষার্থীদের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের পাশাপাশি প্রভাবশালী ব্যক্তিদের আর্থিক ও সামাজিক প্রতিপত্তি বিকাশেরও বিশিষ্ট উৎস হয়ে উঠেছে বিদ্যালয়। এ কারণেই বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির পদ লোভনীয় হয়ে উঠেছে।
কমিটির পদ পেতে যে যোগ্যতা থাকা দরকার তা নেই, কিন্তু সমাজে ‘পর্যাপ্ত প্রভাব’ আছে—এমন ব্যক্তিদের এই সব পদ বাগাতে বিচিত্র কৌশল অবলম্বনের সংবাদ প্রায়ই উঠে আসে। তবে মুন্সিগঞ্জের টঙ্গিবাড়ী উপজেলার রাউৎভোগ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটির সভাপতি হওয়ার জন্য জনতা ব্যাংকের ওই উপজেলার সুবচনী শাখার ব্যবস্থাপক বিল্লাল হোসেন যা করেছেন, তা বিস্ময়কর।
প্রথম আলোর প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, তাঁর সাত মাস বয়সী মেয়েকে ওই বিদ্যালয়ে ভর্তি করানো হয়েছে। অভিযোগ, বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটির সভাপতি হওয়ার জন্য শিক্ষার্থীর অভিভাবকত্বের শর্ত পূরণ করতেই এ কাণ্ড ঘটানো হয়েছে। এটি জানাজানির পর এলাকায় হাস্যরসের সৃষ্টি হয়েছে। প্রধান শিক্ষক বলেছেন, তাঁর অনুপস্থিতিতে কয়েকজন এসে শিক্ষকদের ভয় দেখিয়ে শিশুকে ভর্তি করান। ভর্তি খাতায় শিশুটির নাম তুলেছেন যে সহকারী শিক্ষিকা, তিনি দাবি করেছেন তিনি নন, ভর্তি করেছেন অন্য শিক্ষক। সেই অন্য শিক্ষক বলেছেন, তিনি ভর্তি করেননি, করেছেন প্রথমোক্ত সহকারী শিক্ষিকা। অর্থাৎ দায় চালাচালি চলছে। আর বিল্লাল হোসেনের বক্তব্য হলো, ‘যাঁরা আমাকে এলাকার শিক্ষিত মানুষ হিসেবে সভাপতি বানাতে চাচ্ছেন, তাঁরাই মেয়ের নামটি রেজিস্টার খাতায় লিখেছেন। এ ব্যাপারে আমি কিছু জানি না।’ অর্থাৎ দায় তাঁর নয়, মূল দায়ী ‘এলাকার শিক্ষিত মানুষ অনুসন্ধান করা’ লোকজন।
আশঙ্কা এবং আতঙ্কের কথা হলো শুধু টঙ্গিবাড়ী নয়, দেশের বিভিন্ন স্থানে ‘শিক্ষিত মানুষ অনুসন্ধান করা’ এই কিসিমের লোকজনের সংখ্যা দৃশ্যত বাড়ছে। যে শিক্ষার্থীর মা–বাবা বেঁচে আছে, তাকে ‘এতিম’ বানিয়ে এবং অন্য কোনো ব্যক্তিকে তার তত্ত্বাবধানকারী অভিভাবক হিসেবে দেখিয়ে বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটির পদে বসানো হচ্ছে—এমন খবরও এর আগে সংবাদমাধ্যমে এসেছে।
সমাজের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিনিধিত্বশীল ব্যক্তিত্ব হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠার দুর্নিবার আকাঙ্ক্ষাই হয়তো প্রভাবশালীদের এই ছলচাতুরীতে প্ররোচিত করে। এতে শিক্ষার বৃহত্তর পরিসর যে কলুষিত হয়, সে বিষয়ে ভাবলে তাঁদের চলে না। ‘নিজেরে করিতে গৌরব দান/ নিজেরে কেবলি করি অপমান’—এই রাবীন্দ্রিক উপলব্ধি থেকে তাঁরা হয়তো দূরেই থাকবেন। কিন্তু তাঁদের চাতুরীর বিষয়ে নজরদারি কর্তৃপক্ষকে নির্লিপ্ত থাকলে হবে না। এ বিষয়ে যথাযথ তদন্ত ও উচিত ব্যবস্থা গ্রহণ বিধেয়।