বাংলাদেশের সংবাদপত্রশিল্প একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। আর্থিক সংকট ও আইনের বেড়াজাল সেটিকে আরও তীব্র করে তুলেছে। সরকার সংবাদপত্রকে সেবা শিল্প হিসেবে ঘোষণা করলেও শিল্পের কোনো সুবিধা পাচ্ছে না এ খাত। উল্টো নানা রকম কর, শুল্কের ভারে জর্জরিত এ খাত দিন দিন রুগ্ণ শিল্পে পরিণত হয়েছে। অথচ বাংলাদেশের সামগ্রিক অগ্রগতিতে সংবাদমাধ্যম এবং সাংবাদিক সমাজ বিশেষ ও বড় ভূমিকা পালন করেছে।
বাংলাদেশে সংবাদপত্রশিল্পের সংকট নিয়ে সংবাদপত্রের মালিকদের সংগঠন নিউজপেপার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (নোয়াব) রাজধানীর একটি হোটেলে গত সোমবার একটি গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে। ‘আসন্ন বাজেট এবং সংবাদপত্রশিল্পের সমস্যা ও সংকট’ শীর্ষক এই গোলটেবিলে সংবাদপত্রের মালিক, সম্পাদক, সাংবাদিক নেতা, ব্যবসায়ী, অর্থনীতিবিদ, শিক্ষক ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা অংশ নেন।
নোয়াবের গোলটেবিলে জানানো হয়েছে, দেড় বছর আগে প্রতি টন নিউজপ্রিন্টের দাম ছিল ৫৭০ ডলার, এখন তা হয়েছে ১ হাজার ৫০ ডলার। ছাপা পত্রিকার পাঠক কমলেও অনলাইনের পাঠক বাড়ছে। ফলে সেখানে বিনিয়োগ করতে হচ্ছে। সংবাদপত্রকে সেবাশিল্প ও বর্তমান পরিস্থিতিতে রুগ্ণ শিল্প হিসেবে বিবেচনা করা হলেও সরকারের কাছ থেকে কোনো ধরনের সুবিধা-সহযোগিতা পাওয়া যায়নি। করোনাকাল এবং করোনা-পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন শিল্প খাত সরকারের তরফে নানা ধরনের প্রণোদনা পেলেও সংবাদমাধ্যমকে বিবেচনার মধ্যে নেওয়া হয়নি।
চলমান সংকট থেকে সংবাদপত্রশিল্পের উত্তরণে নোয়াবের পক্ষ থেকে বেশ কয়েকটি দাবি তুলে ধরা হয়েছে। এর মধ্যে সংবাদপত্রের ওপর আরোপিত করপোরেট করহার ৩০ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করা, নিউজপ্রিন্ট আমদানির ওপর ভ্যাট পুরোপুরি প্রত্যাহার কিংবা ১৫ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা, নিউজপ্রিন্টের ওপর আমদানি শুল্ক শূন্য করার দাবি রয়েছে। এ ছাড়া সংবাদপত্রের বিজ্ঞাপন আয়ের ওপর উৎসে কর অসামঞ্জস্যপূর্ণ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কেননা, সংবাদপত্রের বিজ্ঞাপন আয়ের ওপর উৎসে কর (টিডিএস) ৪ শতাংশ। উৎসস্থলে কাঁচামালের ওপরও ৫ শতাংশ অগ্রিম আয়কর (এআইটি) দিতে হয়। অথচ অধিকাংশ সংবাদপত্রের মোট আয়ের ৯ শতাংশ লভ্যাংশই থাকে না।
এ সম্পর্কিত আরও পড়ুনঃ
আর্থিক সমস্যার পাশাপাশি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এবং প্রস্তাবিত উপাত্ত সুরক্ষা আইন, ওটিটি প্রবিধানমালা এবং নীতিমালা ও গণমাধ্যমকর্মী (চাকরির শর্তাবলি) আইনসহ কিছু আইন বাংলাদেশের গণমাধ্যমের জন্য প্রতিকূলতা সৃষ্টি করছে এবং করবে। বর্তমান সংকটময় পরিস্থিতিতে আর্থিক এবং আইনি এই বিষয়গুলোর আশু সুরাহা জরুরি বলে নোয়াবের গোলটেবিল বৈঠক থেকে জানানো হয়।
বৈঠকে নোয়াবের সভাপতি এ কে আজাদ বেশ কিছু বাস্তব সংকট তুলে ধরেন। সেগুলোকে আমরা যৌক্তিক বলে মনে করি। শিল্প হিসেবে সংবাদপত্রশিল্প যে অন্য শিল্পের তুলনায় ভিন্ন, তা সংশ্লিষ্ট সব মহলকে বুঝতে হবে। দীর্ঘদিন ধরে এ শিল্প সমস্যার মধ্যে রয়েছে কিন্তু জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) সংকটের বিভিন্ন দিক বুঝিয়ে বলার পরও সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে কাগজের দাম দ্বিগুণ হয়ে গেছে। সংবাদপত্রের মূল আয় বিজ্ঞাপন কিন্তু কোভিড ও কোভিড–পরবর্তী সময়ের পর তা-ও কমে গেছে। বিজ্ঞাপনের আয়ের ওপরও কর দিতে হয়। আবার সরকারের কাছে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের ১০০ কোটি টাকার মতো বিজ্ঞাপন বিল বকেয়া আছে।
নোয়াবের গোলটেবিল বৈঠকে উপস্থিত প্রায় সবাই সংবাদপত্রশিল্পের সংকট সম্পর্কে একমত পোষণ করেন এবং সমাধানে সরকারকে উদ্যোগ নেওয়ার দাবি জানান। আমরা আশা করব, সরকার, সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয় ও কর্তৃপক্ষ সংবাদপত্রশিল্পের বর্তমান সংকট উপলব্ধি করবে এবং আর্থিক সংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য সংবাদপত্রশিল্পের জন্য বাজেটে করসহায়তা ঘোষণা করবে। সেই সঙ্গে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যমের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়—এ রকম আইনের বেড়াজাল থেকে সংবাদপত্রশিল্পকে মুক্ত করার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে।