রবিশস্যের আমদানিনির্ভরতা কমাতে হবে

বাজারে পেঁয়াজের ঝাঁজ

সরকারের নীতিনির্ধারকেরা বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ বলে যে দাবি করেন, তা আংশিক সত্য; পুরো নয়। ধান উৎপাদনে আমরা সাফল্য অর্জন করেছি এবং সরকার দেশের প্রয়োজন মিটিয়ে বাইরে রপ্তানির কথাও বলেছে। ১৯৭০-৭১ অর্থবছরে বাংলাদেশে ধান ও গম উৎপাদিত হয়েছিল ১ কোটি ৯ লাখ ৭৮ হাজার মেট্রিক টন। ২০১৪-১৫ অর্থবছর শেষে খাদ্য উৎপাদন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ কোটি ৬০ লাখ ৫৮ হাজার টনে। গত তিন বছরে ধান ও গমের উৎপাদন আরও বেড়েছে। কৃষিতে নতুন নতুন উচ্চফলনশীল ধান যোগ হচ্ছে। এই সাফল্যের জন্য কৃষকের পাশাপাশি কৃষিবিজ্ঞানীরাও কৃতিত্ব দাবি করতে পারেন। 

কিন্তু অন্যান্য কৃষিপণ্য, বিশেষ করে ভোজ্যতেল ও রবিশস্য উৎপাদনে এখনো বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে আছে। ভোজ্যতেলের চাহিদার বেশির ভাগই আমাদের আমদানি করতে হয়। সামান্য অংশ এখানে উৎপাদিত হয়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) হিসাবে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে ২৩ লাখ ৩০ হাজার টন পেঁয়াজ উৎপাদিত হয়েছে। আমদানি হয়েছে প্রায় ১০ লাখ ৯২ হাজার টন। অর্থাৎ ৪০ শতাংশের মতো পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়, যার বেশির ভাগই আসে ভারত থেকে। অন্যদিকে রসুন ও আদা আসে চীন থেকে। এ অবস্থায় ওই দুটি দেশে পণ্যের উৎপাদন কমে গেলে কিংবা রপ্তানি কর বাড়ানো হলে আমাদের আমদানিমূল্য স্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। 

প্রথম আলোর খবর অনুযায়ী, নিজেদের বাজার সামাল দিতে ভারত পেঁয়াজ রপ্তানির ন্যূনতম মূল্য প্রতি টনে ৮৫০ ডলার বেঁধে দিয়েছে। এই দরে আমদানি করলে বাংলাদেশে এফওবি (ফ্রেইট অন বোর্ড বা ভাড়া ছাড়া মূল্য) দাঁড়ায় প্রতি কেজি প্রায় ৭২ টাকা। এর সঙ্গে কেজিতে ৫-৬ টাকা ভাড়া যুক্ত হবে। ভারতে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে—এ খবর আসতে না আসতেই বাজারে পেঁয়াজের ঝাঁজ বেড়েছে। কেজিপ্রতি দাম বেড়েছে ২০ টাকা। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় পেঁয়াজকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য হিসেবে ঘোষণা দিলেও এ বিষয়ে তারা কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছে বলে জানা যায় না। 

গত মঙ্গলবার বাণিজ্যসচিব মোহাম্মদ জাফর উদ্দিন পেঁয়াজের দাম নিয়ে যে বৈঠক করেছেন, তাতে মন্ত্রী বা ব্যবসায়ীদের কেউ ছিলেন না। মন্ত্রী অসুস্থ। কিন্তু ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের কেন আমন্ত্রণ জানানো হলো না? ফলে বৈঠকটি বাণিজ্যসচিবের আশাবাদ ব্যক্ত করার মধ্যেই সীমিত ছিল। সচিব সকালে বৈঠক করেছেন, বিকেলেই আরেক দফা দাম বেড়েছে। এটি উদ্বেগজনক। বাণিজ্যসচিব আমদানি শুল্ক কমানোসহ কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলেছেন। কিন্তু সেসব কার্যকর হওয়ার আগেই বাজারে তাপ ছড়াচ্ছে, সেটি কমিয়ে আনা দরকার। 

ভারতে পেঁয়াজের দাম বাড়ার পর কোনো পেঁয়াজ আমদানি হয়নি। আগে আনা পেঁয়াজই বাজারে আছে; যার দাম কোনোভাবে কেজিপ্রতি ৫০–৫২ টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়। অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব আছে। অবিলম্বে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বসে তাঁদের বাধ্য করতে হবে দাম কমাতে। রোগী মারা যাওয়ার পর ডাক্তার ডাকলে কোনো কাজ হবে না। রোগী বেঁচে থাকতেই ডাক্তার ডাকতে হয়। 

এটি হয়তো সাময়িক প্রতিকার। স্থায়ী প্রতিকারের জন্য এসব পণ্যের আমদানিনির্ভরতা কমাতে হবে। দেশে উৎপাদন বাড়াতে হবে। খাদ্য উৎপাদনে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ বলে সরকার যে দাবি করছে, তা শুধু ধানের মধ্যে সীমিত থাকলে হবে না। চাহিদা অনুযায়ী অন্য কৃষিপণ্যের উৎপাদনও বাড়াতে হবে। সে ক্ষেত্রে আমাদের অন্য দেশের মর্জির ওপর নির্ভর করতে হবে না।